e0a6b8e0a682e0a6b6e0a6afe0a6bc Ahmed Imran Halimi

সংশয়

বশিরউদ্দিন মাঝির গত কদিন ধরে বেশ ব্যস্ততায় কাটছে। নতুন একটা খ্যাপ নিয়ে নায়রপুর গঞ্জে এসেছে তার ট্রলার। চালিশার ঘাট থেকে কাঠের চালান নায়রপুরে আনা-নেওয়া করে। উত্তরে নতুন ব্রীজ তৈরী হওয়ায় এখন আর কেউ ট্রলারে চালান পাঠায় না। কিন্তু আমিন শেখের মতো আচ্ছুত লোকেরা এখনো ট্রলারের উপর নির্ভর করেই চলে। এর আগেও কয়েকবার তার চালান আনা-নেওয়া করেছে বশির। বশিরের সঠিক ঘর-বাড়ি কারো জানা নেই। চালিশায় তার খানিক ভিটে-জমি আর একটা ঘর আছে। পরিবারে কেউই নেই। সারা-রাত জুয়া খেলে, মদ খেয়ে পার করায় বাড়িতে যাওয়ার প্রয়োজন পরে না কখনো।

.

সকাল সকাল নতুন চালান নিয়ে এসেছে বশির। আজ খুব ভোরে ঘাটে ট্রলার ভেড়ে। শ্রমিকরা ধরাধরি করে তক্তা নামাচ্ছিল। বশির গা গরম করতে টঙ এ বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল।

.

নায়রপুর গঞ্জ তার জন্যে ততটা অপরিচিত এলাকা নয়। মোটামুটি অনেকের সাথেই পরিচয় আছে এখানে। শিকদার এন্ড সনস টিম্বার-এ প্রায়ই কাঠের চালান দেয় সে। এখানের সব কর্মচারীর সাথে ভাল পরিচয় তার। তবে আলালকে খুব ভাল চেনে। তার কিছিমের লোক বলেই ভাল পরিচিত। জুয়া খেলে, মদে গলা ভেজানো, মেয়েদের সাথে মেলা-মেশা করা এহেন কিছু নেই যা সে করে না।

.

পেয়ালায় যখন চা অর্ধেকে এসে পৌঁছেছে আলাল এসে বশিরের পাশে বসল,

– কেমন যাচ্ছে গো, দাদা?

– কোনোরকমে চইলতাছে।

– কোনোরকম ক্যান? ভালোই তো খ্যাপ পাও দেহি এহন।

– তবুও দাদা। গত রাইতে মাল-পানি পরে নাই। তার উপর চালিশা ঘাটের মহাজন নতুন খ্যাপ নিতাছি শুইনা কর্জের ট্যাকা দেওনের লইগ্যা গুঁতাইতেছে।

– এই হইল গা মহাজনগোর ঘাড় ত্যাড়ামি। আমার মহাজনও তো কাম থেকে একটু বইতে দেখলেই হাঁক শুরু করে দেয়। (চারিপাশে তাকিয়ে একটু মাথা ঝুঁকে বশিরকে কাছে টেনে নিচু স্বরে বলা শুরু করল) তোমারে একখান নতুন খ্যাপ ধরাই দিমু। অনেক ট্যাকা মিলবো, সব ঋণ মিটাই দিয়াও ট্যাকা থাকব!

– কি ব্যাপার, কও তো মিঁয়া।

– এহন চা-বিস্কিট খাও, আমি চালান নামাইয়া আইতেছি।

.

আলাল চলে যাবার পর বশির আবার চায়ের কাপে মনোযোগী হয়ে পড়লো আর আলালের খ্যাপ নিয়ে চিন্তাভাবনা মাথার চারপাশে ঘুরছিল।

.

দুপুরে আলাল আর বশির মা-বাবার দোয়া হোটেলে খাবার খেতে গেল। কোণার একটা টেবিলে বশিরকে নিয়ে বসল আলাল।

.

– তোমার খ্যাপটা কি, কও তো।

– একটু গোপন। কিন্তু খ্যাপটা এতো কঠিন না। গঞ্জের সুপারি বেচা জব্বার মুনশিরে চেনো না? তার মাইয়া রত্নারা বিয়া দেওনের লইগা চিন্তা করতাছে। তুমি বিদেশী মানুষ, বিয়া কইরা নিলেই খেল খতম। বাকি কাম আমার!

– মুনশি কি অনেক যৌতুক দিবে?

– যৌতুক এতো কিছু দিতে পারবে না, কিন্তু কাম হইছে আরেকখান। তুমি সাদী করার বিয়া করবা না। লোক দেখানি বিয়া।

– মানে?

–  আহা মিয়া, এতো অস্থির হইতেছ ক্যান? (সতর্কভাবে চারপাশ দেখে) তুমি বিয়া কইরা এক রাইত বাসর করবা। পরেরদিন তোমার বাড়িতে নেওয়ার কথা কইয়া রত্নারে আমাগো হাতে তুইলা দিবা, বাকিটুকে কালাম ব্যাপারীর কাম। বুঝছো তো? আমি কিছু ট্যাকা নিমু আর তোমারে পঁচিশ হাজার দিমু।

– কিন্তু কামডা ডাকাতি হইয়া গেল না?

– মদ-জুয়ার চেয়ে তো খারাপ না।

– বিয়ার প্রস্তাব পাঠাইবা কিভাবে? আর আমার মতো বৈদেশের মানুষরে মাইয়াই বা দেবে ক্যান?

– ওই কামডা আমার। তুমি ভাইবো না। পরের খ্যাপ কবে?

– সপ্তাখানেক তো লাগবেই।

– তোমার মহাজনের খ্যাপের শ্যাষ দিন বিয়া কইরা নিয়া যাবা। এরপর আর নায়রপুরে জীবনে পা ফালাইতে পারবা না।

.

আলালের মুখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়েছিল বশির। তার হাস্যময় মুখের আড়ালে যে একটা পৈশাচিক মন আছে তা দেখার চেষ্টা করছিল বশির। অন্যদিকে ঋণে জর্জরিত বশির পারছেও না এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলতে।

.

আজ সকাল সকাল বশিরের ট্রলার ঘাটে ভিড়ল। আলাল তার মহাজনের কাছ থেকে আগেই ছুটি নিয়ে রেখেছে। সব কাজ চালানের মহাজনের কাছে দিয়ে ভাল কাপড় পরে বশির ট্রলার থেকে নেমে এলো। কথামতো চায়ের দোকানে আলালের সাথে দেখা করল।

– কি অবস্থা মিঁয়া, ঠিক-ঠাক তো সব?

– হ্।

– তুমি কিন্তু এতো মুখ খুলতে যাবানা। আমি লোক পাঠাইছিলাম জব্বার মুনশির বাড়িতে। তোমার পরিচয় এখন থেকে ট্রলারের মালিক না, চালানের মালিক তুমি।

– আচ্ছা।

– এই দুইজন তোমার মুরুব্বী। একজন তোমার চাচার পরিচয় দিবে, অন্যজন দূরসম্পর্কের আত্মীয়। বাড়িতে বাপ-মা-ভাই কেউ নাই তোমার, বাড়ি কুদলার গাওতে। সেইখানে তোমার টিম্বারের কারখানা আছে। ওইখান থেকে সবখানে চালান পাঠাও। এইগুলান হইল তোমার পরিচয়। তোমার নিজের কিছু কওন লাগব না। যা বলার আমি আর মুরুবীরাই বলুম।

– আচ্ছা মেয়া ভাই, কোন ঝামেলা হবে না তো?

– আরে কোন সমেস্যাই নাই। চলো তাইলে..

.

জব্বার মুনশি আজ বেশ ব্যস্ত। গঞ্জের দোকান বন্ধ রেখে এসেছে। তার বড় মেয়েকে দেখতে আসছে। অনেক প্রস্তুতির ব্যাপার-স্যাপার আছে।

.

আলাল আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা মেয়ে দেখতে এসে বশিরের বেশ প্রশংসা করছিল। অন্যদিকে বশির এক নিবিষ্টে রতনা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। বয়স আর কতই হবে, পনের অথবা ষোল! ভরা কৈশোরবতী মেয়ে। কিন্তু এখনই সাংসারিক চেহারা ফুটে উঠেছে সারা অবয়বে। বাঙ্গালী মেয়েরা কৈশোর থেকেই ঘর সামলাতে বেশ পটু হয়ে যায়। সদা হাস্যময়ী রত্না জব্বার মুনশীর কলিজার টুকরা! মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন, খেয়ে-দেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকা পরিবারে এমন রূপসী, দৃষ্টি নন্দন মেয়ে খুব কমই থাকে।

.

পতিতার বাজারে এইসব কুমারী মেয়েদের প্রচুর চাহিদা। ওইখানে খুব অভাবে পরেই মেয়েরা যায়, বেশীরভাগ প্রতারিত হয়ে আশ্রিত হয়। মেয়েটার জন্যে বেশ মায়া হচ্ছিল বশিরের, কিন্তু তার কিচ্ছু করার নেই। বশির এখন অন্যের হাতের খেলার পুতুল। অনেকটা পরিস্থিতির শিকার হয়ে এই খারাপীটা করছে। বিনিময়ে কিছু টাকা আর এক-রাত ব্যবহারের সুযোগ, মন্দ কি! বশিরের পাশবিক মনটা কিছুটা নড়েচড়ে বসল।

.

– তো নতুন সংসারে বশিররে কি কি দিতাছ, জব্বার মিঁয়া?

– আমাদের অবস্থা বোঝেনই তো, একটা পালংক, আলমারি, ডেসিন টেবিল, আলনা এইসবই দিতে পারুম জামাই বাবারে।

– হইল মিঁয়া, আমাদের ছেলে যৌতুকের ধার ধারে না, তুমি যা দেবা, তাতেই সে খুশি। মেয়ে পছন্দ হইছে আমাগো।

– (সবাই) আলহামদুলিল্লাহ।

– বিয়ার দিনই কিন্তু দিয়া দিতে হবে সব।

– হেইডা নিয়া ভাইবেন না, ভাইজান।

– বিয়া হবে নায়রের গঞ্জেই, তার দোস্তের বাড়িতে। পরদিন কুদলার গাও নিয়া যাবে। তো ওই কথাই রইল, বিয়া আগামী শুক্কুরবারে।

– শুকুর আলহামদুলিল্লাহ!

.

সব কিছু পাকা করে ফেললো আলাল নিজেই। আগামী কয়েকদিন নতুন কোন কাজ হাতে নিবে না। আলালের বাড়িতেই থাকবে বশির। মেয়েটার প্রতি বেশ মায়া লেগেছে বশিরের। সারা রাত মেয়েটার কথা ভেবেছে।

.

পরদিন জব্বার মুনশির বাড়িতে বশির নিজে একাই গেল। এখনই জব্বার মুনশির পরিবারে বেশ জামাই আদর পাচ্ছে। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা ভীড় করছে হবু জামাইকে দেখতে। রতনার সাথে কিছুক্ষণ আলাপ হল তার। রতনার জব্বারের প্রতি কোন আপত্তি নেই। অনেক ভাল লেগেছে তাকে। মেয়েটা নিজের মাকে সব সময় সংসারের কাজে সাহায্য করে। ভাল সংসারি মেয়ে। নিজের পরিবার কিভাবে সাজিয়ে রাখবে তা নিয়েও নিজের স্বপ্নগুলো বলল। নিজের ছেলে-মেয়ের নামও নাকি ঠিক করে ফেলেছে সে। ছেলে হলে রতন, আর মেয়ে হলে বীণা!

.

জব্বার মুনশি ভাল-মন্দ আপ্যায়ন করালো হবু জামাইকে। নিজের মেয়ের অনেক প্রশংসা করল আগ বাড়িয়ে। কিভাবে তাদের সুখের সংসারকে ভালোবেসে গুছিয়ে রেখেছে মেয়েটা। বশীরের পাষণ্ড মন তাদের আজগুবি স্বপ্নগুলোকে পাত্তা দিচ্ছিল না।

.

রাতের বেলা প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল বশিরের। উঠোনে আলালের সাথে কার যেন দর-কষাকষি চলছিল। কথা শেষে লোকটা চলে গেল। আলাল জানালো, এই হল দৌলতদিয়ার কালাম ব্যাপারী। তার কাছেই বিক্রি হয়ে গেছে রতনা। বশিরের খুব ইচ্ছা ছিল কালাম ব্যাপারীকে সামনা-সামনি দেখার। এদের চেহারা কেমন হয়, মানুষের মতো না পশুর মতো তা বুঝতে চেয়েছিল।

.

নতুন পাঞ্জাবী পরে বর সেজে রেডি হয়ে বসে আছে বশির। আলাল ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা সব কাজ-কারবার বুঝিয়ে দিচ্ছিল বশিরকে। ইতোমধ্যে জব্বার মুনশির প্রতিশ্রুত যৌতুক ঘাটে এসে পৌঁছেছে। সেখান থেকে বশিরের ট্রলারে করে নিয়ে যাওয়া হবে। আলালও কয়দিনে গঞ্জে বেশ পরিচিত হয়ে গেছে। তাকেও পালাতে হবে। তার ঘরের সব জিনিসপত্র ট্রলারে ওঠানো হয়েছে। বাসর রাতের জন্যে একটা সাজানো পালংক রাখা হয়েছে শুধুমাত্র।

.

বাসর রাত, আলালের ঘরে নতুন বৌ হয়ে সেজে বসে আছে রতনা। আজ লোক দেখানো এক বাসর হবে রতনার সাথে। আলাল, কালাম ব্যাপারী, বশির উঠোনে বসে মদ গিলছিল। বুদ্ধি করে বশিরকে একটু বেশিই মদ গিলানো হচ্ছে যেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরে। রতনা কুমারী থাকুক, এটাই চাচ্ছিল কালাম ব্যাপারী।

.

পেটে কিছুক্ষণ মদ ঢেলে বশির বাসর ঘরে ঢুকল। আর যাই হোক সামাজিকভাবে রতনা তার স্ত্রী। এক রাতই তো কাটাবে। তারপর কোন এক পতিতালয়ে সারাজীবন বিক্রি হতে থাকবে বেচারী।

.

বশিরের মুখ থেকে প্রচন্ড দুর্গন্ধ আসছিল। রতনার সহ্য হচ্ছিল না। তবুও স্বামী দেখে সব মেনে নিলো। এখনো বশিরের পশু চেহারা উদ্ঘটিত হয়নি রতনার কাছে। মেয়েটা যত্ন করে বশিরকে শুইয়ে দিল।

.

বশির কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ধ্যান করে উঠে জিজ্ঞেস করল,

.

“আজ না আমাগোর বাসর রাইত, ঘুমাই ক্যান আমি?”

.

রতনার ঘুমে বুজে যাওয়া চোখ সজাগ হল। বশির বলে যাচ্ছিল-

.

“সিনেমাতে দেখছি বাসর রাইতে জামাই-বৌ কেস্তা কইরা রাইত পার করে। চলো, আমরাও করি।” বশিরের শিশুসুলভ মনের একটু আঁচ পাচ্ছিল রতনা।

.

ফিক করে হেসে দিল সে।

.

– হাসো ক্যান? আমাকে কি হাসির কিছু কইয়া ফেলছি?

– না, আপনে হাসির কিছু কন নাই।

– তো আমারে হাস্যকর লাগতেছে?

রতনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-

– আপনে অনেক ভাল মানুষ।

– ভালা মনে হইল ক্যান?

– এর আগে বাড়িতে দুইটা প্রস্তাব আইছিল, সবাইই ম্যালা ম্যালা জিনিস চাইত, ওইগুলা দেওনের ক্ষমতা আব্বার ছিল না। আপনি নিজে থেকে কিছুই চান নাই। আব্বা আমাগো নতুন সংসারের লইগা মাল-সামানা দিছে। আব্বা-আম্মা বলছে আপনে অনেক ভালা স্বামী হবেন। আপনারে দেইখাও আমার অনেক ভালা মনে হইছে। আমি সারাজীবন আপনার খেদমত করতে চাই।

.

বশির নিশ্চুপ হয়ে গেল। রতনার প্রতি মায়া হচ্ছিল। নিজেকে সবচেয়ে হতভাগাও মনে হচ্ছিল তার।

.

সকাল সকাল আলালের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল নতুন দম্পতির। সারা রাত রতনা মেয়েটার কথা শুনেছে সে। ফজরের পরে ঘুম দেয়। রতনাকে নামাজ পড়তে দেখে নিজেও নামাজ পরে নেয়। ১০টা বেজে গেছে ইতোমধ্যে। এখনো নতুন দম্পতির সাড়া না পেয়ে আলাল ডাক দিল।

.

– সব কিছু রেডি, মিঁয়া ভাই।

– এহন কি?

– রতনারে জব্বার মুনশির বাড়ি নিয়ে দেখা করাই আনেন। তারপর ওইখান থেইকা ঘাটে আনবেন। আপনাগোর জন্যে আলাদা সাজানো নৌকা রাখা হইছে। ওইটায় ঘাট থেইকা আপনে আর রতনা উঠবেন আর আমরা অন্য ট্রলারে। তারপর চালিশা ছাড়াই একটু পূবে যাইয়া নৌকা থেইকে ট্রলারে উঠবেন। ওইখান থেকে চালান কালাম ব্যাপারী নিয়া যাইবে।

– আইচ্ছা!

.

রতনার চোখের পাতা বেয়ে এই প্রথম অশ্রু ঝরতে দেখল বশির। বাবা-মাকে জড়িয়ে কাঁদছে মেয়েটা। তার সাথে কাঁদছে তার নিকট আত্মীয়রাও। বশির মিথ্যে আশ্বাস দিল যে মাসে মাসে নায়রপুরে পাঠাবে রতনাকে।

.

ওদিকে আলাল তাগাদা দিচ্ছিল। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি নিতে হবে। নদীতে ডাকাতের আনা-গোণা বেড়ে গেছে ইদানীং। ফুল সজ্জিত নৌকায় নব-দম্পতিকে ওঠানো হল। ঝাঁপির নিচে ঢুকল দুইজনে। নৌকায় সাথে আছে বশিরের পাতানো চাচাও।

.

ছেড়ে দিল নৌকা।

.

বশিরের ট্রলার নৌকার সাথেই যাচ্ছিল। রতনার আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে আসার শোক এখনো কাটেনি। এখনো মানাতে পারছে না নিজেকে। মাঝে মাঝে বশিরকে দেখেই যা একটু সাহস পায়। কেউ তো একজন পাশে আছে।

.

বশির গলুইয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে। পূবে ধুপপুরে গিয়ে নৌকা পাল্টাবে তারা। যান্ত্রিক ট্রলার ইতোমধ্যে গন্তব্যে পৌছে গেছে। তাদের নৌকাও দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে  যাবে।

.

বশিরের পাতানো চাচা অন্য গলুইয়ে বসে পান চিবুচ্ছিলেন। আর মাঝে মাঝে পিক ফেলছেন পানিতে। নৌকার মাঝির সাথে একটু-আধটু কথা হচ্ছিল বশির।

.

– তোমার কাছে আর কোনো বৈঠা আছে, মাঝি!

– হ দাদা! পাটাতনের তলে।

বশির পাটাতনের নীচ থেকে আরেকটা বৈঠা বের করে আনল। বৈঠা হাতে করে অন্য গলুইয়ের দিকে যাচ্ছিল বশির। পাতানো চাচা বললো, “কি বশির মিঁয়া, নৌকা চালাইবা নাকি?”

.

“হ চাচা, আমার আপনা নৌকাও আছে একটা! ওইটা মাঝে মাঝেই চালাই।”

.

পাতানো চাচা সরে গিয়ে বশিরের জন্যে জায়গা করে দিতে যচ্ছিল, হঠাৎ বৈঠার আগা দিয়ে সজোড়ে চাচার মাথায় ঘা বসিয়ে দিল বশির। গলুই থেকে পানিতে পরে গেল পাতানো চাচা।

.

“এইটা কি করলা, বশির মিঁয়া? পানিতে ফালাই দিলা ক্যান?”

– তুই মর ওইখানে বুড়া, (মাঝির দিকে ফিরে) মাঝি নৌকা পশ্চিমে নেও।

– আমারে তো পূবে নিতে কইছে আলাল ভাই।

– কয় টাকা দিবে তোমারে আলাল?

– পাশশো!

– আমি তোমারে এক হাজার দিমু, আমার কথা মতো চলো। আর এই বুড়া যেন নৌকার ধারে-কাছে না ঘেষতে পারে।

– কি হইতাছে, বুঝতাছি না।

– টাকা পাইলেই তো হইল, এতো বুঝনের দরকার নাই।

মাঝি পশ্চিমে নৌকা ঘুরিয়ে ফেললো। টাকার পরিমাণ শুনে সজোরে সর্বশক্তি দিয়ে চালাচ্ছিল। সাথে বশির নিজেও যোগ দিল।

.

এতক্ষণ ধরে সব ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিল রতনা। তবুও চুপ হয়ে বসে আছে সে। কিছুক্ষণ আগে বশির বলে যায় কোন কিছু ঘটলে যেন চুপ হয়ে বসে থাকে।

.

পশ্চিমে জায়গামতো আসলে ঘাটে নৌকা ভিড়াতে বলে বশির। সেখানে বশিরের নিজের নৌকা আগে থেকেই এনে রেখেছে তার জিগিরি দোস্ত জালাল। মাঝিকে আরো পাশশো টাকা বেশি দিয়ে তাড়াতাড়ি করে চলে যেতে বলল। জালাল বশিরের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললো,

.

– এইখানে তোর বাড়ি আর ট্রলার বেচার সব ট্যাকা আছে। এইখান থেকে মহাজন ঋণের বিশ হাজার ট্যাকার কর্জ নিয়া রাখছে।

– এই নে, ট্রলারের সব কাগজপত্র। ধুপপুরে ট্রলার ভিড়াইছে। মহাজন আলাল-কালামের থেকে ট্রলার নিতে পারবে তো?

– পারবো না মানে, কাগজ থাকলে শাজাহান মহাজনরে ঠেকায় কেডা? মহাজনেরে দুপুরের মধ্যে লোক পাডাইতে বইলা আইছি। আলালের কাছ থেকে ট্রলার কি, মাল-সামানা শুদ্ধা নিয়া নিবো।

– তোর কাছে সারাজীবন ঋণী রইয়া গেলাম ভাই। তুই আমার আপনা ভাইর চেয়েও অনেক বেশি করছস।

– তোরা এহন কই যাবি? আমারে ঠিকানা দে..

– যেখানে কেউ আমাগোর নতুন জীবনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে আসবে না, সেইখানে…

– ভাবিরে বলছস?

– না রে.. এখনো কই নাই! পরে সময়-সুযোগ পাইলে বলমু। হাতে সময় নাই।

– চালিশায় আর আবি না?

– চালিশা-নায়রপুর যাওয়া সারাজীবনের জন্যে বন্ধ হইয়া গেছে। আমারে পাইলেই মাইরা ফেলবে ওরা। যতদূর চোখ যায় চইলা যামু। ভাল থাকিস, দোস্ত।

.

জালালের সাথে শেষ আলিঙ্গনটুকু করে নিলো বশির। নৌকা এবার উত্তর দিকে টান দিল। গায়ে যতো জোর আছে সব দিয়েই স্রোতের বিপরীতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল নতুন জীবনকে। মাঝে মাঝে রতনার কোমল মুখখানা দেখে সকল কষ্ট ভুল যাচ্ছিল সে। শেষ বিকেলের রাঙ্গা সূর্যখানা বশির-রতনার নতুন জীবনের সূচনার সাক্ষী হয়ে রইল।

.

©আহমেদ ইমরান হালিমী

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *