একসময় ঈদ ছিল আমাদের চরম আনন্দের মুহূর্ত। বড় হয়ে ধীরে ধীরে ঈদের সেই আনন্দটুকু হারিয়ে ফেলেছি। ব্যক্তিগতভাবে জীবনের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে এই আনন্দগুলো রেখে এসেছি। হয়ত কারও কারও কাছে এর আবেদন আগের মতোই রয়ে গেছে।
আমাদের রমজান শুরু হত বিটিভির চাঁদ দেখা সম্পর্কিত বিশেষ সংবাদের উপর ভিত্তি করে। অথবা সংবাদপাঠিকার মাথায় কাপড় ওঠার মাধ্যমে রমজান মাসের আগমনী টের পেতাম। আর তা সমাপ্তি হত “ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষের….” এই সুমধুর ধ্বনির মধ্য দিয়ে। এখনো এই গান না শুনলে আমাদের রমজান শেষের ঈদের আমেজ শুরু হয় না।
বুঝ হবার পর থেকেই রোজা রাখার চেষ্টা করি। একসময় হয়ত বয়সের সাথে রোজা রাখার পরিমাণ ব্যস্তানুপাতিক হারে ছিল। এখন তা সমানুপাতিক হারে রাখার চেষ্টা করি। তবে কখনোই বাবা-মায়ের ফাঁদে পড়ে দিনে ৩ বার করে রোজা রাখতাম না। রোজা রাখলে সবাই যেভাবে না খেয়ে থাকে, ঠিক সেভাবেই রাখতাম।
প্রাইমারিতে যখন পড়ি, একবার রোজা রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করি। আম্মু ওই রাতে সেহেরিতে ডেকেওছিলেন। যেহেতু ছোট ছিলাম, তখন ঘুমগুলো পরিণত আর গাড় ছিল। একবার ঘুমালে সহজে উঠতে পারতাম না। ছোট্ট ছিলাম বলে আম্মু আর এতো জোরাজুরিও করেননি।
সকালে উঠে রাগে জিদে বাসা মাথায় করে ফেলি। না খেয়েই রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। কার সাধ্য আছে আমাকে খাওয়ানোর? না খাওয়া অবস্থায় পুরো দিন কাটালাম। নানাভাবে আব্বু-আম্মু খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল। কেউ বলছিল না খেয়ে রোজা হয় না, দুপুরে খেলে রোজা হয়ে যাবে আরও কতো কি! আমি আমার অবস্থানে অনড় ছিলাম।
ওই অবস্থাতেই বিকালে ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম। হঠাৎ করে মনে হল সামান্য ব্যাডমিন্টনের ভার বহন করার শক্তি পাচ্ছি না। হাতের নিয়ন্ত্রণ হারাই ফেলছিলাম। না খেয়ে থাকার পরিণতি টের পাচ্ছিলাম। একে তো ছোট মানুষ, তার উপর আবার আগের রাতের পর আর খাওয়াও হয়নি। বাসায় এসে শুয়ে পড়লাম। এরপর আরো অনেকবার না খেয়ে রোজা রাখছি। কখনোই সেদিনের মতো এতোটা দুর্বল হইনি।
একসময় রোজার মাসটাই আমাদের কাছে বছরের শ্রেষ্ঠ মাস ছিল। বাকি ১১ মাস শেষে কবে রোজা আসবে, কবে ছুটি আসবে, সেই প্রহরই গুণতে থাকতাম। রোজা রাখি বা না রাখি সারা বছর রমজানের আমেজটা চাইতাম। একমাস জুড়ে মানুষ ও নিজের মধ্যে যে পরিবর্তন লক্ষ করি, আশা করতাম সারা বছর জুড়ে যেন এটাই যেন থাকে আমাদের মাঝে। রোজার মাসের বাতাস, আলো, পরিবেশ সবই ভাল লাগত। সারা বছর জুড়ে শুধু এই একটা মাসের অপেক্ষায়ই ক্যালেন্ডারে হিসেব কষতাম।

আগে আমাদের সব কিছুতেই চাহিদা কম ছিল। ঈদ উপলক্ষে বাবা-মা যা কিনে দিত, তাইই নিতাম। এখন কত-শত আজগুবি চয়েজের মারপ্যাচ, তাও বাছ-বিচার করে কেনার পরও খুশি হতে পারি না। তখন এক পাঞ্জাবী দিয়েও ২ ঈদ কাটিয়ে দিতে পারতাম। এখন বেড়েছে চাহিদা, বাজেট করে কিনি, একটা পোশাকের জন্য ১০টা দোকান ঘুরি, বন্ধুর পাঞ্জাবীর দাম শুনে আফসোস করি, লোক দেখানো সব আয়োজন করি, আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে ভিন্ন সংস্কৃতির হিট তারকাদের পোশাক কেনায় প্রলুদ্ধ হই। যতো বেশি দোকান ঘুরে কিনতে পারি, যতো দামী পোশাক বাগাতে পারি, যতো অদ্ভুত পোশাক পরতে পারি, ততোই মনে করি রমজানের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পেরেছি।
কোনো এক ঈদে দেখলাম ছাতার মত চকচকে কাপড়ে তৈরি কালো পোশাকে ঈদ সয়লাব, পরে শুনি এটা Krrish ছবির নায়কের ড্রেস। এক পোশাকে রেইনকোর্টের কাজ হয়ে যেত। আরেকবার দেখি প্যান্টের সাথে চেইন লাগিয়ে কাটা আলা জ্যাকেট হিট খেল। এটা নাকি “পাগলু” কালেকশন। সবচেয়ে বেশি কালেকশনের গ্যাঞ্জামে থাকে মেয়েদের পোশাক। প্রতি ঈদে আলোচিত বা সমালোচিত কোনো নায়িকার পোশাক বাজিমাত করবে। কোনো একবার “পাখি” ড্রেস না কিনে দেওয়ায় আত্মহত্যা, ডিভোর্স অনেক কিছু হয়ে গিয়েছিল। আমি সবসময় ঈদের বাজারে যে টাইপের পোশাক বেশি চলত, সেইটাকে এড়িয়ে পলিথিনে প্যাকেট করা সাদামাটা কিছু একটা নিতাম। অন্তত অন্যদের থেকে আলাদা থাকা যেত।
ঈদের দিন সালামি জমানোটাও একটা বিশাল আনন্দপূর্ণ কর্মযজ্ঞ ছিল। বেশি টাকা সালামি পেতাম না কখনোই। তাই রমজান জুড়ে অল্প অল্প করে টাকা জমাতাম। কোনো কোনোবার ২-৩ মাস আগে থেকেই টাকা জমানো শুরু করতাম। একেবারে নাদান থাকা অবস্থায় কত টাকা সালামি পেতাম কিংবা আদৌ পেতাম কিনা জানি না। তবে ছোট ভাইয়ের যখন টাকা-পয়সা চেনার জ্ঞান হয়নি, এমন এক ঈদে ওকেও আম্মু ৫ টাকার সালামি দেয়। ওর মুখে সেইদিন যে আনন্দ দেখেছি তা অকল্পনীয় ছিল। এই হাসিটুকু হাজার টাকার সালামি দিয়েও এখন কেনা সম্ভব না।
প্রাইমারী কি আন্ডার প্রাইমারী থাকাকালীন বাসা থেকে ৫০ থেকে ১০০ টাকার সালামী পেতাম। আশেপাশে থেকে আর যা পেতাম তাই ছিল ঈদের বখশিশ। এই ক’টাকা নিয়েই বেড়িয়ে পড়তাম সারা এলাকা ঘুরতে। প্লাস্টিকের পুতি পিস্তল তখন সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল। বড় ভাই আর আমি মিলে ওই পুতির পিস্তল কিনতাম। সেটাই সিনেমার ভিলেনদের মতো কোমরে গুজে রাখতাম। রাস্তায় কুকুর-বেড়াল দেখলেই শ্যুট করতাম। ওই পুতির পিস্তলই ঈদের লেটেস্ট উপহার ছিল। ঈদের আগে লাদেন বোমা কিনতাম। কিন্তু প্রতিবারই লাদেন বোমার মাথা হারাই যেত। টিনের পিস্তল ২-১ বার কিনে ছিলাম। হাত কেটে যেত, তাই ওটা কিনতাম না আর। ভাইয়ের সাথে বাসায় পুতির পিস্তল দিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলতাম। এভাবেই অল্প তুষ্টিতে ছেলেবেলাকার ঈদ পার করে দিয়েছি। এখন ঈদ সালামী পাই না। বাসা থেকে নেই না এমনিও। বরং মাঝে মাঝে সালামী দেওয়া লাগে। এখন সুযোগ পেলে একটু ঘুরে আসেই ঢাকা বা ঢাকার বাইরে।
এখনো কি পুতির পিস্তল কেনা হয়, এখনো কি সবাই আগের মত রোমাঞ্চ আসে?
আগে এখনকার মতো ইফতার পার্টির বালাই ছিল না। প্রতিবেশীদের বাড়িতে ইফতারি পাঠানোর সুবিদিত রীতি ছিল। আর এতো পরিচিত প্রতিবেশী ছিল যে রমজানের অর্ধেক জুড়েই ইফতারি পেতাম। নিজেরাও আবার তাদের দেওয়ার চেষ্টা করতাম। খুব পরিচিত কেউ থাকলে বাসাতেই ইফতারের দাওয়াত দিত। সে সময় বসুন্ধরা ছিল না (মানে আমার যাওয়া হত না), কেএফসি, পিজ্জাহাট, আনলিমিটেড ইফতার অফার গুলো সবে মাত্র মাথা উচু করে দাঁড়াচ্ছিল। ছিল না আজকালকার মতো বন্ধুদের সাথে চেক ইন দেওয়া ইফতার পার্টিগুলো। প্রত্যেকটা অলিখিত চেক ইন হিসেবে ছিল একরাশ ভালোবাসা।
ইভেন্ট করে গরিব-অসহায় মানুষদের ইফতারি খাওয়ানোর ব্যাবস্থা তখনো গড়ে ওঠেনি। পরিবার থেকেই সপ্তাহে ২-১ জন গরিবকে ইফাতারী খাওয়াতাম। টাকা-পয়সা বেশি ছিল যাদের তারা মসজিদ-এতিমখানায় মুক্তহস্তে দান করত। তা দিয়ে সারা মাস গরীবদের ইফতারীর ব্যবস্থা চলত। গরিবদের ঈদের নতুন পোশাক কিনে দিতে পরিবার থেকেই ছোট ছোট উদ্যোগ নিতাম। আজকাল তরুণদের দ্বারা পরিচলাইত চ্যারিটি ফাউন্ডেশন এই দায়িত্ব নিয়েছে। এটা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য।
নিজেদের ঈদের পোশাক কেনার সাথেই আশেপাশের পরিচিত কোনো অসহায় মানুষের জন্য পোশাক কিনতাম। টাকা-পয়সা অল্প ছিল তাই কোনো পরিবারের ১ কি ২ জনের চাহিদা মেটাতে পারতাম। কখনোবা এক বিল্ডিং এর সবাই মিলে একটা পুরো পরিবারকে সাহায্য করতাম। এরা হয়ত ছিল আমাদের দারোয়ান, ঝাড়ুদার, কাজের লোক কিংবা পরিচ্ছন্নতাকর্মী। সবার ভালোবাসা সাথে নিয়েই ঈদ করতাম। তাই আমাদের আনন্দও ছিল আকাশ সমান।

যাদের টাকা-পয়সা ছিল তারা নীরবেই ১০-১২টা পরিবারকে খুশি করতো। কারো মধ্যে প্রচারণার মোহ ছিল না। শহরে-গঞ্জে কিংবা নিজের গ্রামের বাড়িতে গরীবদের ঈদ পোশাক বিতরণের রীতি ছিল তাদের মধ্যে।
ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারীর শুরুর দিকের রমজান গুলো আরো তাৎপর্যময় ছিল। বার্ষিক পরীক্ষার পর রোজা শুরু হত। কোনদিক দিয়েই চাপ ছিল না। তবে সেহেরীতে উঠতে বেশ কষ্ট হত। বাবা-মা পর্যন্ত অনেকসময় উঠতে পারতেন না। অনেকসময় সেহেরি না খেয়েই রোজা রাখতে হত। দিন ছোট ছিল। ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশে কষ্টও কম হত। তাই রোজা রাখতেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম।
শীতকালে চাদর মুড়িয়ে ইফতার-সেহেরি করতাম। গরম গরম ধোয়া ওঠা পেঁয়াজু, বেগুনি অমৃত লাগত। অল্প খেয়েই শান্তি পেতাম। বাতাসের অক্সিজেনও ফ্রেশ থাকত। এই ঈদগুলো ঢাকায় করা হয়নি, চট্টগ্রাম ছিলাম। পরিবেশও দারুণ ছিল সেখানের। বুক ভরে অক্সিজেন নিয়েই ইফতারি করে ফেলতে পারতাম!
ছোটবেলায় রমজানের সময় মসজিদে নতুন করে কুরান শরীফ পড়া শিখতে যেতাম। যখন নিজে পড়তে পারতাম, কুরআন শরীফ খতম দিতাম। দুপুর টাইমটা বাসার সবাই মিলে কুরান শরীফ নিয়ে বসে পড়তাম।

ঈদ কোনো আত্মকেন্দ্রিক উৎসব না। সবাইকে নিয়েই আনন্দ উপভোগ করাই ঈদ। আশেপাশের মানুষকে দূরে ঢেলে মনের শান্তি নিয়ে কখনোই ঈদ উপভোগ করা সম্ভব না। অন্যকে খুশি করার মধ্যেই স্বার্থকতা নিহিত। আর রমজান মাস উপলক্ষে সওয়াবের আশায় আমরা অনেক ভাল কাজ করার চেষ্টা করি। রমজানের এক মাস থেকে যে শিক্ষা অর্জন করি তা আমাদের বছরের বাকি ১১ মাসে প্রতিফলন ঘটানোর জন্য অনুপ্রেরণা দেয়। এক মাসেই সেভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে হয়।
কিন্তু আমরা ২৯ কি ৩০ রোজার পর ঈদের দিন থেকে আবার দুনিয়াগ্রস্থ হয়ে পরি। একদিন আগেও যে ছেলেটি ফজর নামায পর্যন্ত মিস করতো না, সেও ঈদের দিন থেকেই নামায পড়া ছেড়ে দেই।
শালীনতা বিষয়টাও আমরা রমজানকেন্দ্রিক করে ফেলেছি। যেই নারী সারা বছর শরীর প্রদর্শন করিয়ে বেড়ায় তার মাথায়ও মাসখানেকের জন্য কাপড় ওঠে। মনে হয় যেন আল্লাহ সারা বছর কিছুই দেখেন না, এই একমাস সবার কৃত কর্মের হিসাব নেন। অথবা এই একমাসের শালীনতা সারা বছরের পাপমুক্ত করে দেয়।
আমাদের অতীত, বর্তমান এমন অনেক কিছুরই সাক্ষী হয়ে থাকছে প্রতিনিয়ত!
Nice writing ..go on…