Pilot Saiful Azam

দূঃসাহসিক ‘লিভিং ঈগল” খ্যাত বাঙালী পাইলট সাইফুল আজম

আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনুপ্রাণিত হই বীরেদের গল্প শুনে। বীরেরা ফ্রন্টলাইনে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছিল বিশ্বের সেরা ল্যান্ড ফিল্ডের দূর্ধর্ষ ট্রেনিং প্রাপ্ত মিলিটারীর সাথে। হ্যা, পাকিস্তানী মিলিটারি তদানীন্তন সময়ের সবচেয়ে দূর্ধর্ষ মিলিটারী ফোর্স ছিল। তাদের একটা বিশাল  কমান্ড বাহিনী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত হত। এই বাহিনীর সাথে খালি হাতে মোকাবেলার প্ল্যান থেকে ১১ টি মিলিটারী সেক্টর করা, পাকিস্তানী বাহিনী থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত বাঙ্গালী ও ভারত থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত সাধারণ বাঙ্গালীরা মিলে গড়ে তুলেছিল শক্তিশালী গেরিলা ও কমান্ডো বাহিনী। 

মুক্তিযুদ্ধের বীর ছাড়াও আমাদের ছিল এমন কিছু বীর যারা জলে, স্থলে, আকাশে ছিলেন দূঃসাহসিক। যারা নড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রতাপশালী শত্রুর সুদৃঢ় ভিত। এমনই এক বীরযোদ্ধা আকাশের দূর্ধর্ষ ঈগল গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম। তাঁর ইতিহাস জড়িয়ে আছে আরেক বীর পাইলট বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের সাথে। 

saif ul azam Ahmed Imran Halimi
সাইফুল আযমের আর্ট

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান করাচীর মৌরিপুর বা মাসরুর এয়ার বেইজে জেনারেল পাইলট হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তাঁর প্রশিক্ষক ছিলেন সাইফুল আজম। ২০ শে আগস্ট মতিউর রহমান যখন টি-৩৩ বিমান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্যে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। বিধিবাম, মতিউর রহমানে কো-পাইলট পাকিস্তানী রাশেদ মিনহাজ টের পেয়ে গেলে তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়ে শেষমেশ বিমানটি ভূ-পাতিত হয়।

সাইফুল আজমকে এরপর ২১ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁর ফাঁসির হুকুমও হয়ে যেতে পারত। একই সাথে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান না করার জন্য পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল এ রহিম খান ও জর্ডানের বাদশাহ হুসেইনের অনুরোধ ছিল বলেও ধারণা করা হয়। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের খেতাবপ্রাপ্ত পাইলট, তাই তাকে তেমন কিছু করা হয়নি শেষ পর্যন্ত। 

download Ahmed Imran Halimi
পাকিস্তানী আর্মিতে থাকাকালীন

সাইফুল আজমের জন্ম ১৯৪১ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের পাবনার খগড়বাড়িতে। ভারত ভাগের পূর্বে বড় হন কোলকাতায়। এরপর ১৯৪৭ এ ফিরে আসেন মাতৃভূমি বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৫৮ তে তিনি পাকিস্তান এয়ারফোর্স ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে পাকিস্তান মিলিটারিতে এয়ার ফোর্সে জয়েন করেন। ১৯৬০ সালে তিনি পাইলট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হন। যোগদান করেন পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে। সেখানে তিনি টি-৩৭ বিমানের পাইলট ছিলেন। 

এরপর উচ্চতর প্রশিক্ষণে তাকে আমেরিকার এরিজোনায় লিউক এয়ারফোর্স বেজে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি এফ-৮৬ বিমানের পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। বলাবাহুল্য, এফ-৮৬ তদানীন যুক্তরাষ্ট্রের সেরা জঙ্গী বিমান ছিল। এটি পঞ্চাশের দশকের সেরা দুটি বিমানের একটি ছিল। অন্যটি ছিল সোভিয়েতের মিগ-১৫ জঙ্গী বিমান। তাঁর পাইলট হিসেবে চাকুরীর একটি অংশে ঢাকায় পোস্টিং করা হয়। সেটি বেশ সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে ছিল।

এরপর তিনি করাচীর মৌরি বিমান ঘাঁটিতে বদলী হন। যা এখন মাশরুর ঘাঁটি নামে পরিচিত। যে ঘাটির নাম আমরা অনেকবার শুনেছি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের জীবনীতে। তাকে টি-৩৩ বিমানের পাইলট হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সেই বিমানের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে পরবর্তীতে তিনি মতিউর রহমানের প্রশিক্ষক ছিলেন।

group captain saiful azam Ahmed Imran Halimi
সাইফুল আজম

মাশরুর ঘাঁটিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৯৬৫ এর পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি এফ-৮৬ বিমানের পাইলট হিসেবে প্রত্যক্ষ সমরে অংশ নেন। সেই যুদ্ধে তিনি রেখেছিলেন অসাধারণ কৃতিত্ব। ভারতীয় পাইলট মায়াদেব-এর বিমানকে প্রচন্ড ডগফাইটে ভূ-পাতিত করেন। এর কৃতিত্ব স্বরূপ তিনি পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক সিতারায় জুরাতে ভূষিত হন এবং ১৯৬৬ সালে বিমান বাহিনীর দ্বিতীয় স্কোয়াড্রনের কমান্ড লাভ করেন। 

১৯৬৭ সালে ৬ দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পাকিস্তানী মিলিটারীর কিছু অফিসারদের যুদ্ধের আগেই উপদেষ্টা হিসেবে  জর্ডান, ইরাক, সিরিয়া, মিশরে পাঠানো হয়। এতে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন সাইফুল আজম। ও তাঁর সঙ্গী হিসেবে পাকিস্তানী সারওয়ার শাদ। তিনি জর্ডান সরকারের অনুরোধে জর্ডান বিমান বাহিনীর উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। তারা রাজকীয় জর্ডান বিমান বাহিনীর হকার হান্টার অপারেট করেন। 

৫ জুন ১৯৬৭ সালে আরব ইসরাইল যুদ্ধ চলাকালীন সাইফুল আজম ছিলেন জর্ডান এয়ার বেজে। ইজরাঈলী বাহিনীর অতর্কিত হামলায় ধ্বসে যায় জর্ডানের আল-মাফরাত বিমান ঘাঁটি। আজম তাঁর হকার হান্টার নিয়ে উড্ডয়ন করে ইজরাঈলী মিস্টেয়ার-৪ বিমানকে প্রচন্ড ডগফাইটে ভূ-পাতিত করেন। মিস্টেয়ার-৪ ছিল সেইসময়ের দূর্ধর্ষ এক বিমান। যেখানে হকার হান্টার কিছুই ছিল না। কিন্তু আযমের রণকৌশল ও নিখুত নিশানার কাছে প্রচন্ড শক্তিশালী বিমানও ধ্বসে যায়। 

Group Captain Saiful Azam 1 Ahmed Imran Halimi
সাইফুল আযমের কিছু অর্জন

এর দুইদিন পর তিনি ইরাকের বাহিনীর অনুরোধে সেখানে নিযুক্ত হন। তিনি যখন পশ্চিম ঘাঁটিতে অবস্থান করছিলেন, তখন ইজরাইলী বাহিনী সেখানে হামলা করে বসে। ১২.৪৮ মিনিটে ৪ টি ইজরাইলী বিমান অতর্কিত হামলা করে। তিনি এবার ইরাকী হকার হান্টার নিয়ে আবার নেমে পড়েন। এই ডগফাইটে তিনি একটি Mirage-3 ও একটি বোমারু “ভেটোর বোম্বার” বিমানকে ভূপাতিত করেন। 

সাইফুল আজমকে আরব-ইজরাঈলী যুদ্ধে কৃতিত্বের জন্যে রাজকীয় Order of Istiqlal পদকে ভূষিত করা হয় এবং ইরাকের পক্ষ থেকে সাহসিকতার সর্বোচ্চ পদক Nut al-Shujat এ ভূষিত করা হয়।

সাইফুল আজমের কৃতিত্ব ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। জর্ডানের বাদশাহ নিজে এসে দূঃসাহসিক পাইলটের খোঁজ নেন। এরপর তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে করে অন্য এক আহত পাইলটকে দেখতে যান তারা। ইরাকে ‘এইচ থ্রি’ ঘাঁটিতেও দ্বিতীয়বারের মত ব্যর্থ হওয়ার পর ইজরাইলি বিমান বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মওদেহাই হড বিবৃতি দেন, “এইচ-থ্রি ঘাঁটিতে আমাদের ব্যর্থতার জন্য যত সমালোচনার শিকার হয়েছি তাতে মনে হয়েছে, আমি যেন যুদ্ধটা হেরেই গেছি। আমাদের বিমানগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ার পেছনে যত কারণই থাকুক না কেন, এটার পেছনে ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একটি দল ও তাদের দলপতি হিসেবে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন অত্যন্ত উঁচুদরের পাইলট। এই অসম্ভব দক্ষ দলটির ব্যাপারে এমনকি মোসাদও ভালো মতন জানত না।”

১৯৭১ এর পর তিনি ফিরে আসেন মাতৃভূমি বাংলাদেশে। বাংলাদেশে ফিরে তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ডিরেক্টর অব ফ্লাইট সেইফটি পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি ডিরেক্টর অব অপারেশন পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৭৭ তিনি উইং কমান্ডর হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকায় অবস্থিত বিমান ঘাঁটির বেজ কমান্ডর হন। ১৯৭৯ সালে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে সমাপ্তি ঘটে তাঁর বর্ণিল ক্যারিয়ারের। 

১৯৮০ সাল থেকে সিভিল এভিয়েশন অথোরিটিতে দুই মেয়াদে প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে নাতাশা ট্রেডিং নামক নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের হয়ে পাবনা-৩ আসন থেকে ১৯৯১-৯৬ সালে নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন।

সাইফুল আজম একমাত্র পাইলট হিসেবে ৪টি দেশের বিমান বাহিনীতে কাজ করেন। পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক ও বাংলাদেশ। এছাড়া তিনি দুটি দেশের মিলিটারী বিমান ভূপাতিত করেন। তারপরের বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০০ সালে আমেরিকার এয়ার ফোর্সের LIVING EAGLE খেতাবে ভূষিত করা হয়। আকাশপথে জঙ্গী বিমান নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে সত্যিই আজম ছিলেন এক পরাক্রমশালী ঈগল পাখির মতো, যার নির্ভুল ও লক্ষ্যভেদী নিশানা কাঁপিয়ে দিয়েছিল সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী বিমান বাহিনীকেও। তিনি ৮ টি দেশের বিমান পরিচলনা করেছিলেন। ৭২ ঘন্টায় ভূপাতিত করেছেন ইজরাঈলের ৩টি শক্তিশালী এয়ারক্রাফট। গত ৪৮ বছরে এই রেকর্ড আনব্রেকেবল!

 ১৯৬০ সালে বিয়ে করেন সাইফুল আযম। তাদের ঘরে এক মেয়ে আছে।  ১৪ই জুন ২০২০ সালে ৭৯ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি ইন্তেকাল করেন। 

সাইফুল আজম আমাদের সুপার হিরো। দুটি বড় বড় আন্তর্জাতিক যুদ্ধে তিনি বীরত্বের সাথে লড়াই করেছেন বিশ্বের শক্তিধর সব এয়ারক্রাফটের বিরুদ্ধে। তাঁর নিখুঁত রণকৌশল ও প্রবল আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা। ভিত নড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বের ধূর্ত ইজরাঈলী এয়ারক্রাফটের। এমন একজন মানুষ আরও বেশি অনুপ্রেরণার গল্প সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু আমরা তাকে সেই পর্যায়ে তাঁর জীবদ্দশায় চিনতে পারিনি। কিংবা তাকে চেনানোর মত সুযোগ করে দেওয়া হয়নি। এখনো বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের কোনো শিক্ষানবিস পাইলটকে হয়ত শোনানো হয় এই বীরের বীরত্বগাঁথা। যিনি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন এমন হাজারও বাঙালী পাইলটের নিকট। আমরাও গর্ব করতে পারি এমন একজন দূঃসাহসিক রণকুশলী আমাদেরও ছিলেন।

রেফারেন্সঃ

১। সাইফুল আজম: বাংলার আকাশের এক দুঃসাহসী ‘লিভিং ঈগল’

২। Saiful Azam