ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সাইবার অপরাধ

ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সাইবার অপরাধ

সোশ্যাল মিডিয়া ফ্রড, সাইবার ক্রাইম, হ্যাকিং, ডেটা ব্রিচ বর্তমান ভার্চুয়াল দুনিয়ায় খুবই কমন একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফোনে ইন্টারনেট কানেকশন, আর দুইপাশে দুইটা ক্যামেরা নিয়া আমরা কেউই এখন আর সেইফ না। যেকোন মুহূর্তে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরের কেউই আমাদের ক্যামেরা অপারেট করার ক্ষমতা রাখে। আর সেইখানে যদি সোশ্যাল মিডিয়া বা যেকোনো ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্ম ইউজ করে কোনো তথ্য বা ছবি শেয়ার করি, সেটা অন্য কারও আয়ত্ত্বে চলে যাওয়া হ্যাকারদের ইচ্ছা মাত্র। আপনি আইটি প্রফেশনাল হয়ে যতই ফোনে একটার পর একটা সিকিউরিটি সিস্টেম দেন না কেন, এইগুলা ব্রেক করা তাদের কাছে নস্যি। আমরা এই সাজানো গোছানো ভার্চুয়াল জগতের একটা পুতুল মাত্র! ফেইসবুকে অমুক লগিন কোড, তমুক ২ স্টেপ ভেরিফিকেশন যাইই ব্যবহার করেন না ক্যানো, এই সাইটটা খুবই উইক। আইটি প্রফেশনালরা স্বয়ং জাকারবার্গের ফেইসবুক একাউন্ট হ্যাক করে তাঁর তৈরি সোশ্যাল মিডিয়ার ত্রুটি অনেক আগেই ধরিয়ে দিয়েছে।

আজকাল অল্প টাকা খরচ করেই দারুন দারুন সব ফোন স্মার্টফোন কেনার সুযোগ পাচ্ছি নতুন নতুন মোবাইল কোম্পানির বদৌলতে। ফ্ল্যাগশীপ, হাই পারফর্মিং চিপসেট, ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ডিসপ্লে, মানুষের চোখের লেভেলের কাছাকাছি ক্যামেরা ইত্যাদি নানারকম আকর্ষণীয় টোপে এসব ফোন কিনতে লালসা তৈরি করা হয়। এইসব এন্ড্রয়েড ফোনের সাথে জোর করেই গুগোলের সব সার্ভিস দিয়ে দেওয়া হয়, বাধ্য হয়েই এগুলো আপনাকে ব্যবহার করতে হবে। হয়ত গুগোলের সমতুল্য রিপ্লেসমেন্ট আমাদের মত সাধারণদের হাতের নাগালে নেই বলেই, গুগোল নির্ভর হয়ে পড়েছি। গুগোলের সাথে জড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমরা খাওয়া দাওয়া, ঘুম, চলাফেরা, কথাবার্তা, দৈনন্দিন কার্যক্রম, কি খুঁজছি, কেন খুঁজছি ইত্যাদি প্রতিটা মুভমেন্ট আমি আপনি বিনাপয়সায় গুগোলকে সেল করে দিচ্ছি। গুগোল আমাদের ফ্রিতে তাদের প্রায় সকল প্রোডাক্ট ব্যবহারের সুযোগ দেয়। বিনিময়ে ব্যক্তিগত তথ্যগুলো আমাদের কনসেন্ট নিয়েই মার্কেটারদের কাছে বেচে দিচ্ছে। আপনার মেইল আইডি হ্যাক করলেই আপনার সমস্ত ভার্চুয়াল একাউন্টের পাসওয়ার্ড হ্যাক হয়ে যাবে। কারণ ইতোমধ্যে আপনি গুগোল স্মার্ট লকের মাধ্যমে আপনার পাসওয়ার্ড রিমেম্বার করার অনুমতি দিয়ে রেখেছেন। আপনার ক্রেডিট কার্ডের ইনফো, খরচাপাতির হিসাব, কোন ব্যাংকে একাউন্ট চালান, কখন কখন ব্যাংকে যান, সবই গুগোল আমাদের সম্মতিতেই জেনে নিচ্ছে। গুগোল আপনাকে নিশ্চিন্ত করছে যে, আপনার তথ্য তাদের কাছে সেইফ, বাট আপনার একাউন্টের সেইফটি আপনার হাতে। সেটা কারও কব্জায় চলে গেলে আপনার সবকিছু তাঁর কাছে। গুগোল ডকসে লেখা আপনার সকল গোপনীয় তথ্য, Google Photos এ দেওয়া আপনার সকল ব্যক্তিগত ছবি, গুগোল এক্সেলে তৈরি করা আপনার কোম্পানীর স্যালারি তথ্যাদি, কর্মীদের ব্যাংক একাউন্ট ইনফো, কোম্পানির একান্ট হিসেব সব কিছুই এক নিমিশেই অন্য কারও হয়ে যেতে পারে।

তথ্য প্রযুক্তির ট্রাপে আমরা সকলেই বাধা হয়ে গেছি। সন্যাসব্রত গ্রহণ করে সকল প্রযুক্তিকে বিদেয় দিয়ে নব্বইর দশকের মত জীবনযাপন করা এখন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখন সবই পেপারলেস, ক্যাশলেস। এই সব সুযোগ-সুবিধা ছাড়া আমাদের জীবনও একদম অচল। তাই বেছে নিতে হবে এসবের সচেতন ব্যবহার। ২০২১ সালে ৬ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিগ্রস্থ হবে বিভিন্ন সাইবার ক্রাইমের মত অপরাধের কারণে। পৃথিবীতে যদি শতকরা ১০০ জনের মধ্যে ০.১ জনের ডাটা ব্রিচ হয়, সংখ্যাটা খুব নগন্য হতে পারে, কিন্তু আপনি জানেন না ওই ০.১ জনের মধ্যে আপনিই থাকতে পারেন কিনা। যেমনি আমরা কেউই জানি না, আমরা কখন মারা যাব। তাই নিজের ব্যক্তিগত ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করার ব্যাপারে সচেতনতা আবশ্যক। আপনার তথ্য যদি একান্তই অনলাইনে শেয়ার করার প্রয়োজন পড়ে, সেট শেয়ার করে কিছুক্ষণের মধ্যেই ডিলিট করে ফেলুন। আর কখনোই সোশ্যাল মিডিয়াকে ভায়া করে তথ্য শেয়ার করবেন না। এমনকি কল দিয়ে তথ্য শেয়ার করাও ভয়ানক। টাকা পয়সা খরচ না করলে এন্ড টু এন্ড এনক্রিপ্টেড মিডিয়া ব্যবহারের সুযোগ খুবই কম।

নিজের ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার, ব্যক্তিগত ভিডিও শেয়ার যারা প্রাণচ্ছলে করে ফেলেন, তারা কতটা সহজ-সরল মনে এই সোশ্যাল মিডিয়াকে বিশ্বাস করে ফেলেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়। কোনো তৃতীয় চোখকে আপনার শরীরের কিছু অংশ দেখানোও এই যুগে শুধু বিপদ নয়, ঘোরতর অন্যায়। এই বোকামির দন্ড হিসেবে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে হয়েছে। আপনি যদি মনে করেন আপনাকে সবাই দেখলেও আপনার কিচ্ছু যায় আসে না, আপনি আপনার ব্যক্তিগত সম্মানকে থোরাই কেয়ার করেন, এই সব পরামর্শ আপনার জন্যে না। সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে এসে আমরা বোকার মত কাজ করে ফেলি, এতটাই নেশাযগ্রস্থ হয়ে থাকি যে আমরা কখনোই ফিউচার ইম্পেক্ট এনালাইসিস না করেই কিছু একটা করে বসি। জাকারবার্গের মত ট্যালেন্টেড প্রোগ্রামার তাঁর নিজস্ব ফেইসবুক একাউন্টের সিকিউরিটি দিতে ব্যর্থ। আপনি যাইই হন না কেন, বাংলাদেশের টপ ইঞ্জিনিয়ারিং এর সিএসই গ্রাজুয়েট কিংবা সদ্য গুগোল থেকে অফার পাওয়া কেউ, আপনার একাউন্টের সিকিউরিটি আপনি কখনোই দিতে পারবেন না।

আইটি প্রফেশনালরা খুবই ক্রিয়েটিভ ও বুদ্ধিমান হয়ে থাকে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই সারা দুনিয়ায় তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব চলছে। কিন্তু সবাইই ভাল কিছু করবে, তাঁর সম্ভাবনা কখনোই নাই। কেউ গুগোল, ফেইসবুকের মত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকও হতে পারে, আবার কেউ কেউ একই জ্ঞান নিয়া লাখ লাখ মানুষের ক্রেডিট কার্ড হ্যাক করে বিলিয়ন ডলার নিমিষেই উপার্জন করে নিতে পারে। কে কোন পথ বেছে নিবে সেটা একান্তই তাদের নিজস্ব ব্যাপার।

এই ভার্চুয়াল জগতকে যারা শাসন করছে, তাদেরকে মানবিক হিসেবে তৈরি করার আগেই তারা আমাদের হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু আমি বা আপনি যারা ভার্চুয়াল জগতের সুবিধা ভোগ করছি, আমাদের ডিজাটাল লিটারেসি নিয়েই বরঞ্চ বেশি বেশি কাজ হওয়া উচিত। আমরা কোথায় কি শেয়ার করতে পারি, কিভাবে মানবিক কার্যক্রমে সোশ্যাল মিডিয়াতে যুক্ত থাকতে পারি, কিভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি এসব বিষয়ে আমাদের ডিজিটাল লিটারেসির খুব প্রয়োজন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার একটা আইসিটি বই ঢুকিয়ে দিয়েছে পাঠ্যক্রমে, তবুও আমরা শিখতে ব্যর্থ হচ্ছি। তাই আমাদের সবচেয়ে বড় যে অস্ত্র, বিবেক, এটাকে ব্যবহার করে চলতে পারি। বিবেক দিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলেই আমরা অনেক ভাল-মন্দের সমাধান পেয়ে যাই।

তথ্য প্রযুক্তি আইন আরও বেশি শক্তিশালী হওয়া উচিত বাংলাদেশে। আমরা শুধু তথ্য প্রযুক্তির আইন বলতে এক ৫৭ ধারাই চিনি, তাও আবার সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ সম্বন্ধে ঘাটাঘাটি করে কিছু বিষয় সম্বন্ধে জানতে পেরেছি। আমাদের তথ্য প্রযুক্তি সেলে শক্তিশালী আইটি প্রফেশনালরা আসে না, যারা সাইবার ক্রাইমের অপরাধীদের ধরার কাজে নিয়োজিত রেখে ভার্চুয়াল স্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে। ভূ্খন্ড আর আকাশ ও নৌ সীমানাকে সার্বভৌম ও স্বাধীন রাখার পাশাপাশি ভার্চুয়াল জগতও স্বাধীন রাখার সময় এসে গেছে এখন। আমাদের সরকারি বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের আইটি সেলে নেওয়া হয় ব্রুনাইয়ের মুদ্রা নাম জানা লোকদের কিংবা বিজয় কীবোর্ড ব্যবহারে পারদর্শীতা থাকাদের। প্রোপাগান্ডা ছড়াতে খোলা ভুয়া ফেইসবুক গ্রুপের তথ্য দিয়েও আমি ডিবি আইটি সেলের কোনো সাহায্য পাই নাই। এরা মেসেজ সীন করেই কাজ উদ্ধার করে ফেলে। মাঝেমাঝে ২-১ টা পুচকে অপরাধী ধরে ফেইসবুকে শোরগোল করে ফেলে। বড় হ্যাকাররা সবসময়ই থাকে এদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাইই ডিজিটাল মাধ্যমে নিজের সচেতনতার বিকল্প নেই।