২৫ বছর পূর্ণ করার পূর্বেই জনপ্রিয়তা, সাফল্য, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সবই অর্জন করে ফেলেছেন OYOর প্রধান নির্বাহী রিতেশ আগরওয়াল। তিনি এমন এক বয়সে এত কিছু অর্জন করে ফেলেছেন, যখন আমরা অনেকেই এসব নিয়ে ভাবিও না। দেশে শিক্ষার্থীবান্ধব স্টার্টআপ কালচার বিগত বছরগুলোর তুলনায় বেড়েছে বৈকি। কিন্তু ভিশনারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা এখনো নগন্য। আশেপাশ থেকে সহায়তা না পাওয়া, প্রভাবিত হওয়া ইত্যাদি কারণে দেশে স্টার্টআপ এখনো গড়ে উঠছে না। আমাদের ভাবনাতেই থাকে, আপনি যখন কোন স্টার্টআপ তৈরির পিছনে খেটে মরছেন, তখন আপনার সহপাঠীরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী, সরকারী জব, প্রাইভেট সেক্টরসমুহ বাগিয়ে নিচ্ছে। এর উপর দেশে বিজনেসের ঝুঁকি, ফান্ডিং এর অনিশ্চয়তা, উদ্যোগী মাইন্ড সেটআপের অভাবের কারণে অধিকাংশই বিজনেসে থিতু হতে পারছেন না।
অন্যদিকে রিতেশ আগারওয়াল কলেজ ড্রপ আউট হয়ে ছুটেছিলেন তাঁর স্বপ্নের পিছনে। পেয়েছেনও সাফল্য। এই বয়সে যখন মাস শেষে আপনার পকেটে যখন সামান্য কটা টাকা শেষ সম্বল হিসেবে থেকে যায়, সেই বয়সে রিতেশের নেট সম্পদের পরিমাণ ১.১ বিলিয়ন ডলার। পারিবারিক সহযোগিতা ও কোনো প্রকার লাইম-লাইট ছাড়াই নিজ পরিশ্রমে অল্প বয়সেই রিতেশ বনে গেছেন ভারতের একজন তরুন বিলিয়নার হিসেবে! আজ শুনব তারই গল্প!
নির্ঘণ্ট
শুরুর গল্প
স্কুল লাইফের যে বয়সে আমাদের অনেকেরই নতুন নতুন ক্রেজের স্রোতে গা ভাসাতেই চলে গিয়েছিল, সেই বয়সে রিতেশ মোবাইল সিমের ব্যবসা শুরু করে। রিতেশের জন্ম ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে। তাঁর যখন ১৩ বয়স অর্থাৎ ২০০৬ এ ভারতে তখন মোবাইল সিমের দারুন ব্যবসা। রিতেশের সেই বয়স থেকেই নতুন নতুন কনজিউমার গুড নিয়ে পরীক্ষা চালাতে শুরু করেন। এভাবেই তাঁর বিজনেস লাইফের এক্সপেরিমেন্টের শুরু।
২০১২ তে তখন সব কলেজ পড়ুয়া রিতেশ, এরইমধ্যে তাঁর এক আইডিয়া OYO Rooms ভেঞ্চার নার্সারি নামক এক্সিলারেটর প্রোগ্রামে জাজদের গ্রহণযোগ্যতা পায়। আইডিয়াটা ছিল বিভিন্ন ট্যুরিস্ট প্লেস, বিনোদনমূলক স্থানসমূহে অনলাইনের মাধ্যমে আরামদায়ক ও বাজেট হোটেল, বাড়ি, খালি স্পেস শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। আইডিয়াটা একটু পুরনো লাগতে পারে আপনার কাছে। ২০০৮ এ ব্রায়ান, জো, নাথানের AirBnB নামক এমনই এক অনলাইন ভিত্তিক স্টার্টআপ শুরু করেছিল, যেখানে আমেরিকান যে কেউই তাঁর বাড়ির খালি স্পেস, ব্রেক ফাস্ট পর্যকটকদের সাথে শেয়ার করে উপার্জন করতে পারবেন, পর্যটকরাও স্বল্প খরচে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। আইডিয়াটা হয়ত ৫ বছর আগেই উন্নত বিশ্বে জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এমন স্টার্টআপ ওই মুহূর্তে ছিল বিশাল ঝুঁকির মধ্যে। সেটাকে তোয়াক্কা না করেই রিতেশ এগিয়েছেন নিজের মত করে।
স্টার্টআপ এর প্ল্যান শুরু করার আগে রিতেশ ভারতের অনেক স্থানে ঘুরেছেন, অনেক হোটেল, গেস্ট রুমে থেকেছেন, সেখানকার খাবার ট্রাই করেছেন। ঘুরতে ঘুরতে তাঁর মনে হয়েছিল ভারতে এখনো স্বল্প খরচে কমফোর্ট এবং ভাল মানের থাকার স্পেসের খুবই অভাব। সেই অভিজ্ঞতা থেকে ট্যুরিস্ট ও মুসাফিরদের জন্যে স্বল্প খরচে উন্নত মানের থাকার জায়গা নিশ্চিন্তের প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখা থেকেই OYO এর যাত্রা শুরু হয়।
এক্সিলারেটর প্রোগ্রাম থেকে ১ লাখ ডলারের ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে ২০১৩ সালের মে থেকে মাঠে নামেন রিতেশ। ২০১৮ সালের শেষদিকে OYO বিলিয়ন ডলার কোম্পানীর তালিকায় নাম লেখায়, আর ২ বিলিয়ন ডলার কোম্পানী হতে সময় নেয় মাত্র এক বছর। রিতেশের কোম্পানীতে এখন কাজ করছে ১৫০০ জন কর্মী, আর কোম্পানীর ভ্যালুয়েশন দাঁড়িয়েছে আড়াই বিলিয়ন ডলারে!
রিতেশ আগরওয়াল পড়াশুনা নিয়ে কখনোই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না
সেলফ মেইড বিলিয়নার রিতেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েশন নেই। তাতে কি হয়েছে? সে এখন তাঁর সমস্ত সহপাঠীদের চেয়ে ভাল অবস্থানে নিয়ে যেতে পেরেছেন। রিতেশ মনে করতেন যে, সে যদি পড়ালেখায় খারাপ করে, তাতে তাঁর বাবা মা নারাজ হবেন। তার যেহেতু পড়শোনার চেয়ে ব্যবসা-ই বেশি টানছিল, তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে বাবা-মা যেহেতু খারাপ ফলাফলের জন্যে এমনিও কষ্ট পাবেন, এটাকেই ছেড়ে দিয়ে পূর্ণ সময় ব্যবসায় মনোযোগ দেওয়াই তাঁর কাছে সহজ। রিতেশ আগারওয়ালের লিংকডইন প্রোফাইল ঘুরে আসতে পারেন।
সফল হওয়ার পুর্বে ছয়বারের ব্যর্থতা
রিতেশ আগারওয়ালের স্টার্টআপ জার্নি কখনই গল্পের মত সহজ ছিল না। ২০০৭ থেকে মোবাইল সিমের ব্যবসা দিয়ে ব্যবসায়ী জীবন শুরু তাঁর। আমরা এটুকুই জানি। ২০১২ পর্যন্ত মাঝের ৫ বছর আরও অনেক ব্যবসার সাথেই সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। কোনোটাই শেষমেশ আশার আলো দেখেনি। তাঁর OYO Rooms সফল হওয়ার আগে তিনি ছয়বার ব্যর্থ হয়েছেন।
সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা
ভারতের উড়িশ্যার ছোট-খাট একটি দোকানের ব্যবসা রয়েছে রিতেশের বাবার। বাবার সেই পুঁজিও কখন ছিল না ছেলের ব্যবসায় লগ্নি করবেন। এর চেয়ে পড়াশোনা করিয়ে গড়পড়তা ভাল চাকুরীজীবী বানানো, পরিবারের হাল ধরানো, এমনই সাধারণ একটি স্বপ্নই তাঁর বাবার কাছে বেশি বাস্তব ছিল। কিন্তু রিতেশ সবসময়ই দুর্দান্ত কিছু করতে চেয়েছিলেন। প্রতিটি উদ্যোক্তার পিছনে একটি গল্প আছে। তিনি ক্ষুদ্র ক্ষদ্র বিজনেসের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে অভিজ্ঞতা নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। নিজের দ্বিতীয় উদ্যোগেই ধীরে ধীরে সাফল্য অর্জন করা শুরু করেন তিনি।
প্রাথমিকভাবে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা তাঁর বিজনেস সম্বন্ধে যা ভাবেন
ইনভেস্টরদের থেকে স্টার্টআপের জন্যে টাকা বের করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না তাঁর জন্যে। তিনি যখন সহজ পদ্ধতিতে হোটেল বুকিংয়ের প্রক্রিয়ার সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করেছিলেন, তখনও ভারতে OYO এর মতো কোন স্টার্টআপ শুরু হয়নি। বিনিয়োগকারীরা সকলেই প্রথমদিকে তাঁর উদ্যোগকে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা ভেবে বসেছিলেন, আস্তে আস্তে এক্সিলারেটর প্রোগ্রাম শেষ হতে হতে রিতেশ দারুন একটা আইডিয়া দাঁড়া করিয়ে ফেলেন।
OYO কে খাড়া ঝুঁকিপূর্ণ পর্বতে আরোহন করতে হয়
যতটা সহজ ভাবছি, OYO ততোটা সহজেও সফলতার চূড়ায় আসেনি। তার জন্যে শুরটা ছিল দারুন এক চ্যালেঞ্জ। অভিজ্ঞতা সায় দিলেও রিতেশের বয়স এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সায় দিবে কিনা, তা নিয়ে ছিল সন্দেহ। এই চ্যালেঞ্জ এখনও অব্যাহত রয়েছে। ১৬০ টি শহরে ছড়িয়ে থাকা ৪৫,০০০ টি রুম, সেগুলোর সুযোগ-সুবিধা, কাস্টমার স্যাটিসফেকশন বজায় রাখা, ট্রিপ এডভাইজরে 4* রেটিং বজায় রাখা এবং চুক্তিতে গ্রাহকদের সর্বাধিক সন্তুষ্ট করা বেশ কঠিন কাজ ছিল তাঁর মতো নবাগতর জন্যে।
আরও পড়ুনঃ লিংকড ইন – আগামী দিনের প্রফেশনালদের প্ল্যাটফর্ম
আন্তর্জাতিক বাজারে OYO Rooms এর বাজিমাত
রিতেশ মনে করেন ওয়োর কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগী নেই যাঁরা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং যখন ছাড় এবং ইনভেস্টমেন্টের বিষয় আসে, OYO এই ব্যাপারে সবসময়ই কিছুটা ছাড় পেয়ে এসেছে। এখন ৮০ টি দেশের ৮০০ শহরে দূর্দান্তভাবে ব্যবসা করছে।
রিতেশ ২০১৬ সালে ফোর্বেসের এশিয়া প্যাসিফিক এডিশনে “৩০ আন্ডার ৩০” নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়াও রিতেশ ও তাঁর স্টার্টআপের ঝুড়িতে রয়েছে বিজনেস ওয়ার্ল্ড ইয়াং অন্ট্রাপ্রিনিউর এওয়ার্ড, টি আই ই ল্যুমিস বিজনেস এক্সিলেন্স এওয়ার্ড, ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলমার্ট এওয়ার্ড, লুফথানসা রানওয়ে টু সাকসেস এওয়ার্ড সহ আরও কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা। তবে স্টার্টআপের সেরা অর্জনই হল কাস্টমার স্যাটিসফেকশন আর প্রফিট। এই দুটি অর্জনে নিরন্তর লড়ে যাচ্ছেন তরুণ রিতেশ ও তাঁর দল!