e0a6ace0a78de0a6afe0a6b0e0a78de0a6a5 e0a6aae0a78de0a6b0e0a6a3e0a6afe0a6bc Ahmed Imran Halimi

ব্যর্থ প্রণয়

আইডিয়াল কলেজ প্রাঙ্গণ, আগস্ট ১৯৯৪.
.
সকাল থেকেই ফুরফুরে বাতাস বইছে। গত কয়েকদিন বৃষ্টি হয়েছিল বেশ। সুজনের ফুচকা ব্যবসাতেও মন্দা গেল কয়েকদিন। বৃষ্টির জন্যে এই কয়দিন তার ফুচকার জমজমাট ব্যবসার স্পটে আসা হয়নি। এর উপর আবার বৃষ্টি-বাদলের কারণে অনেকগুলো ফুচকা ফেলে দেওয়া লেগেছে। মচমচে ফুচকাগুলো মেসে রাখার কারণে শুকিয়ে নরম হয়ে গেছে। সাধারণত মেসে ফুচকার বস্তা নিয়ে আসা লাগে না। কলেজে বসেই সব বেচা-বাট্টা হয়ে যায়। শনিবার পাইকারী বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসার পর থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, টানা তিনদিন পিটপিট করে বৃষ্টি নেমে তাকে বাঁশ(!) দিয়ে গেল।
.
এই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শহরবাসীর জন্যে অনেক আনন্দের। সব বাড়িতে খিচুরি রান্না চলে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা ইলিশ কিনে জম্পেশ ঘরোয়া চড়ুইভাতি করে। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের আনা-গোনা কমে যায়। সবার হাতেই ছাতা থাকে। শহরের আবর্জনাময় পথ-ঘাট বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যায়। এই বৃষ্টির যে কত প্রয়োজনীয়তা!
.
কিন্তু সুজনের জন্যে মোটেই এই আসমানের পানি আনন্দের নয়। তার জন্যে হাজার হাজার দুর্ভোগ নিয়ে আসে। ফুচকার ব্যবসায় বেশ লস খেতে হয়। ফুচকা বিক্রি করেই তার জীবন চলছে এই শহরে। নিজের পড়ালেখার খরচ, মেস ভাড়া, বাড়িতে টাকা পাঠায় এই ফুচকা বিক্রি করে।
.
সুজন নটরডেম কলেজে মানবিক বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে। সুদূর কুড়িগ্রামের নায়রহাট গ্রামের ভূমিহীন কৃষক পরিবারের ছেলে। পুরো স্কুল জীবনে বৃত্তির টাকায় পড়াশোনা করে এতদূর এসেছে সে। সাথে কৃষাণ খেটেও বাবাকে সাহায্য করেছে। ম্যাট্রিকে পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউন্ড বিজ্ঞান বিভাগ থাকলেও পরবর্তীতে নটরডেম কলেজে এসে আর্টস বিভাগ নিয়ে ভর্তি হয়। শহরে আর্টস বিভাগের টিউশনির বাজার মন্দা দেখে এই লাইনে যেতে পারেনি। যদিও তার বেসিক ভাল ছিল বলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর ক্ষমতা থাকা সত্বেও কোনো বাবা-মা সাহস করে না মানবিক বিভাগের স্টুডেন্ট বলে।
.
কল্যাণপুরের জীর্ণশীর্ণ এক মেসে থাকে সে। কলেজের পাশে হোস্টেলে থাকার সামর্থ্য তার নেই। এরপর সে আবার একজন ফুচকাওয়ালা। হোস্টেলে তার ফুচকার সরঞ্জাম রাখতে দিত না। মেসে বরঞ্চ অনেক সুবিধাই হয়েছে তার জন্যে। সব রকমের নিম্নবিত্ত মানুষ এখানে থাকে। এক ফুচকাওয়ালার কাছ থেকেই ফুচকা ব্যবসার আইডিয়াটা পায়। উনিই সুজনের জন্যে ফুচকার জিনিস-পত্র বানিয়ে দেয়। গুলিস্তান থেকে ফুচকার প্যাকেট আর মশলা সুজন নিজেই কিনে আনে। সুজন আর নিজের জন্যে ফুচকার আলু সিদ্ধ, পেয়াজ, মশলা মাখিয়ে আলাদা করে সকাল সকাল গুলিস্তানে বিক্রির জন্যে চলে যায়। আর সুজন যায় আইডিয়াল কলেজ স্পটে। ওখানে আরো এক ত্যাদর ফুচকাওয়ালা থাকলেও কাস্টমাররা তার ফুচকাই বেশি পছন্দ করে। বেচা-কেনা ভাল যায়। দুপুরে গাট্টিপত্র মেসে রেখে কলেজে রওনা দেয়।
.
৩ দিন পর আজ সকাল থেকেই আকাশ পরিষ্কার ছিল। যদিও সূর্যের দেখা তখনো মেলেনি। ফুরফুরে বাতাস বইছিল। সুজনের পরনে পাতলা একটা জামা। বেশ শীত লাগছে তার। মেয়েদের ক্লাসের সময়টাতে আন্টি, ছোট বাচ্চারা ফুচকা খায়। আজকে তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মাথা ভর্তি কুইজের টেনশন। আজকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর কুইজ পরীক্ষা। মোটামুটি পড়া আছে। তিন দিন বেরোতে পারেনি দেখে বাসায় পরতে পেরেছে। তবুও হালকা টেনশন ভর করছে।
.
একটু পরেই ক্লাস ছুটি দিবে। প্লেট, চামচগুলো আরেকবারের জন্যে দেখে নিচ্ছে সে। মেয়েগুলো বড্ড বেহায়া। একটু ময়লা পেলেই ঘিন ঘিন করে। তবে সবার কাছেই ফুচকা মামা নামে বিশেষভাবে পরিচিত সুজন। কম বয়সী আন্টিরাও মামা ডাকে। ঢাকা শহরের তদানীংকার বেশ জনপ্রিয় শব্দ।
.
জীববিজ্ঞানের ম্যাম বড্ড ঝামেলার মানুষ। ছুটির ঘন্টা দেওয়ার পরও আরো কয়েক মিনিট ধরে ক্লাস নিয়ে যাচ্ছেন। অন্য ক্লাসের মেয়েরা বেরিয়ে গেছে। জুলেখা ম্যামের ওদিকে খেয়াল নেই। একটু বেশিই সিরিয়াস তিনি। দীপার মন আজকে ক্লাসে নেই। গত তিনদিন ফুচকাওয়ালা আসেনি। এই কয়দিন বৃষ্টির মধ্যেই দীপা ক্লাসে এসেছে, কিন্তু ফুচকার ছেলেটা আসেনি। আজ ফুচকাওয়ালা এসেছে, সব ক্লাসেই বেখেয়ালি ছিল সে। শেষ ক্লাসে ম্যাডামের জন্যে আবার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজকেও অন্য সেকশনের মেয়েগুলো ফুচকা-মামার সামনে গিয়ে ভীড় করে দাঁড়িয়ে ন্যাকামি করবে। এগুলো দেখলে তার পিত্তি জ্বলে যায়।
“সরি মেয়েরা, আমি ভেবেছিলাম এর পরে তোমাদের ক্লাস আছে, তাই তোমাদের নেক্সট টিচারের অপেক্ষা করছিলাম। তোমাদের ১০ মিনিট বেশি ক্লাস নিয়ে ফেললাম।” কথাগুলো শুনে শম্ভিত ফিরে এলো দীপার। ম্যাডামকে ভর্তসনা করতে করতে বেরিয়ে এলো সবাই।
.
ফুচকা-মামার দোকানে প্রচন্ড ভীড়। সুজনের দম ফেলার জো নেই। দীপা কখনো সুজনকে ফুচকা মামা বলে ডাকে না। এই, এই যে, শুনো এভাবে সম্বোধন করে। সুজন ছেলেটাকে তার ভাল লাগে। এতো নিষ্পাপ একটা ছেলে। ফুচকা খেতে খেতে তার ব্যস্ততা দেখতে খুব ভাল লাগে দীপার। সবার প্রতি কেয়ারিং ভাব আছে তার। কি সুন্দর করে সবাইকে “আপা” বলে। যদিও দীপাকে এখন আর আপা ডাকে না। দীপার আব্দার ছিল নাম ধরে ডাকুক। কিন্তু সুজন পারে না। তবে দেখলেই স্মিত হেসে কেমন আছে জানতে চায়!
.
দীপা কয়দিন ধরে সুজনের সাথে একটু-আধটু গল্প করার চেষ্টা করে। কিন্তু সুজন কাস্টমার না থাকলে কেন জানি দ্রুত চলে যায়।
.
একটু ভীড় কমলে দীপা এগিয়ে আসে। সুজনের কপাল থেকে ঘাম ঝরছিল। দীপাকে দেখে ম্লান চেহারায় একটু হাসি ফুটে ওঠে। দৈনন্দিনের মতো ৫ টাকার ফুচকা বানানো শুরু করে।
.
– এতোদিন তোমাকে দেখলাম না যে?
– কই এতোদিন? মাত্র তো তিনদিন!
– তিনদিন তোমার ফুচকা মিস করেছি।
– আমি কি সাধে আসি নাই? বৃষ্টি পড়ল যে। অর্ধেক ফুচকা নষ্ট হয়ে গেছে।
– তোমার তো অনেক লস হয়ে গেছে তাইলে।
– হ্যাঁ। এই নেন আপনার প্লেট!
দীপার জন্যে বানানো ২ টাকার ফুচকার প্লেট এগিয়ে দিল সুজন।
“আচ্ছা, তোমার বাসা কই?” প্রথম ফুচকা মুখে পুরতে পুরতে দীপা জানতে চাইল।
– কুড়িগ্রাম।
– এতদূর থেকে ফুচকা নিয়ে আসো?
– না, এইখানে মেসে থাকি।
– মেসে!
– হুম
সুজনের ক্লাসের সময় হয়ে আসছিল। মেসে গিয়ে রেডি হতে হবে। দীপা মেয়েটাও ঝামেলা করছে প্রচন্ড।
– আমার একটু তাড়া আছে।
– কেন?
– কলেজে পরীক্ষা।
– তুমি কলেজে পড়? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল দীপা।
– হুম। নটরডেম কলেজ।
– কোন ইয়ার।
– সেকেন্ড ইয়ারে। মেসে গিয়ে গোসল করে রেডি হতে হবে। আপনাররটা শেষ হলেই আমি যেতে পারি।
– আচ্ছা নেও। কালকে আসছ?
– আসতে তো হবেই। এটাই যে আমার জীবিকা!
.
প্লেট ধুয়ে ফুচকার গাট্টি নিয়ে হন হন করে ছুটে চলল সুজন। দীপা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর মুগ্ধ হচ্ছে।
.
আজ দীপাদের শেষ পিরিয়ডে রসায়ন ক্লাস ছিল। ঘণ্টা পরার সাথে সাথেই বেরিয়ে পরে। আজ সুজনের কাছ থেকে অনেক কিছুই জানা লাগবে। এতোদিন তাকে নিছক ফুচকাওয়ালা মনে করেছে। সে একজন কলেজ পড়ুয়া ছাত্রও বটে। সুজনের ফুচকার সামনে দাড়িয়ে আছে। অনেক কাস্টমার ফুচকা খাচ্ছে। একটু ফ্রি হোক সুজন।
.
– কেমন আছো?
– এই তো চলছে, আপনার কি অবস্থা?
– ভাল। এখনো আপনি বলে সম্বোধন করো। আমি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি আর তুমি সেকেন্ড ইয়ারে।
– তাহলেই কি ‘আপনি’ বলে ডাকা যায়? আমি সামান্য ফুচকাওয়ালা!
– তবুও, আমি কিন্তু রাগ করবো।
– আচ্ছা, চেষ্টা করবো। দাঁড়াও তোমার ফুচকা বানাচ্ছি।
– আজকে তোমার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানব।
– আচ্ছা!
.
দীপার ৫ টাকার ফুচকা বানিয়ে দিল সুজন। আস্তে আস্তে জেনে নিলো তার জীবনের সব লুকানো কথাগুলো। ফুচকাওয়ালাদের গল্প কেউ জানতে চায় না। দীপা খুবই আগ্রহী ওকে নিয়ে। দীপা জানছে আর অবাক হচ্ছে। সুজনও কলেজের কথা ভুলে গিয়ে একনিষ্ঠ মনে বলে যাচ্ছিল।
.
– আচ্ছা, তুমি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মানবিকে গেলে কেন?
– আমার একটুর জন্যে বিজ্ঞান বিভাগে অ্যাপ্লাই করার রেজাল্ট আসেনি। রসায়নে সেকেন্ড ডিভিশন ছিল।
– তাহলে অন্য কলেজে ভর্তি হতে।
– আমার ছোটবেলা থেকেই নটরডেমে পড়ার ইচ্ছা ছিল। বাড়ির পাশে এক দাদা পড়তেন। তখন থেকে ইচ্ছা। এজন্যে বিভাগ পরিবর্তন করি।
– ওহ, আচ্ছা।
.
আরো কিছুসময় গল্প করতে চাচ্ছিল দীপা। সুজন ক্লাসে যাবার তাগাদা দেওয়ায় উঠে গেল।
.
এভাবেই বেশ কিছুদিন তাদের কথা চলল। আজকাল দীপা সুজনের কলেজের সামনে দাড়িয়ে থাকে। বেরোলে হাটতে হাটতে গল্প করে।
.
আজ হঠাৎ করেই দীপাকে হন্তদন্ত দেখাচ্ছিল। সুজন কলেজ থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে দীপা ওকে কমলাপুর নিয়ে যায়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা জানাবে। সারাদিন এই মুহূর্তের জন্যে ছটফট করছিল।
.
– আচ্ছা বলো, কি এমন কথা আমাকে বলতে চাচ্ছ!
– সুজন, আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি।
– হুম।
– তাই এতো প্যাঁচাতে পারছি না।
– হুম
– আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি..
.
– ও..!
– এভাবে জবাব দিচ্ছ কেন? আমি তোমার উত্তর জানতে চাই।
– তুমি অনেক আবেগী একটা মেয়ে, দীপা। তুমি বুঝতে পারছো একজন ফুচকাওয়ালাকে কি বলছো।
– তুমি একজন ফুচকাওয়ালা না, সুজন। তুমি একজন জীবন সংগ্রামী ছেলে।
– তো। এটা তো মিথ্যা না, আমি তোমার কলেজের সামনে ফুচকা বেচি। তোমার সম্মান কথায় নামবে জানো? তোমার বন্ধুরা হাসবে। জীবনটা এতো সহজ নয়, দীপা।
– তুমি তাহলে ফুচকা বিক্রি ছেড়ে দাও।
– এটা ছেড়ে দিলে তো আমাকে না খেয়ে মরতে হবে।
– আমি তোমাকে প্রতি মাসে টাকা দিবো।
– তোমার বাবার অনেক টাকা আছে সত্য। কিন্তু এভাবে আমি নিজেকে বিক্রি করি না।
– তাহলে… আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।
– চেষ্টা করলেই বাঁচবে।
– তুমি টিউশনি করাতে পারবে?
– পারবও, কিন্তু আর্টসের ছাত্রদের টিউশনির বাজার নেই।
– আমি তোমাকে ছোট ক্লাসের ছাত্র এনে দিবো। আমার পরিচিত। তারা তোমাকে টিউশনিতে অনেক টাকা দিতে পারবে।
– কিন্তু..
– আর কোনো কিন্তু নয়। তুমি ফুচকার চেয়ে বেশি টাকা আয় করবে। আমি তোমাকে তেমন টিউশনি এনে দিবো। শুধু পড়াবে আর তোমার কলেজ, থাকা-খাওয়ার খরচ চালাবে।
– বিনিময়ে তোমাকে ভালোবাসতে হবে?
– বিনিময়ে কেন বলছো, আমি তোমাকে মন থেকে ভালোবাসি যে…
.
দীপা মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলছিল। মেয়েদের চোখের জল অনেক বড় একটা অস্ত্র। সুজনের শক্ত মনটাও নিমিষে গলে গেল। এক হাতে দীপার অশ্রু মুছে, অন্য হাত দিয়ে নিজের অশ্রু সামলাচ্ছিল। এই ব্যস্ত শহরেও তাকে নিয়ে ভাবার কেউ আছে। শেষবিকেলের আলোটাও একটা নতুন সম্পর্কের আড়ালে হারিয়ে গেল।
.
পরদিন থেকে আইডিয়াল কলেজের ফুচকাওয়ালা সুজনকে আর পাওয়া গেলো না। এখন একজন প্রেমিক সুজন প্রতিদিন দাড়িয়ে থাকে তার প্রেমিকাকে বরণ করে নিতে।
.
দীপার কল্যাণে ৩ টা টিউশনী মিলল সুজনের। একজন নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, অন্য দুইজন জুনিয়র ক্লাসের। বিদ্যা বেচে ভালোভাবেই চলে যাচ্ছিল তার। দুইজনের সাক্ষাতের খরচ দীপা নিজেই বহন করত। ভালোবাসা দিনে দিনে গভীর থেকে গভীরতর  হচ্ছিল।
.
ঘনিয়ে এলো সুজনের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা, অন্যদিকে দীপার টার্ম এক্সাম। একটু বিচ্ছিন্ন রইল দুজনেই। সুজন দুই একবার বাড়িতেও গিয়েছিল মাঝে। তবে টিউশনির জন্যে বেশিদিন থাকতে পারেনি।
.
সুজনের একটাই ইচ্ছা ছিল ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে বাবা-মা কে ঢাকায় নিয়ে আসবে। ইন্টার পরীক্ষা বেশ ভাল দিল। সুজন কোচিং-এ ভর্তি হল। লক্ষ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর্টস ব্যাকগ্রাউন্ডে পড়াশোনার জন্যে ভাল প্রতিষ্ঠানই ছিল ঢাবি। আর দীপার সাথে সম্পর্ক রাখতেও ঢাবিতে পড়া ছাড়া বিকল্প ছিল না।
.
ঢাকা বোর্ডে প্রথম বিভাগ পেয়ে স্ট্যান্ডও করল সুজন। কলেজের শিক্ষক-ফাদাররা অনেক আশীর্বাদ করেছিল সুজনের জন্যে। বাবা-মা রেজাল্টের মর্ম না বুঝলেও বুঝেছিলেন ছেলে ভাল পাশ করেছে। সেদিন সবচেয়ে খুশি হয়েছিল দীপা।
.
সুজন ঢাবিতে চান্স পেয়ে অর্থনীতি পেল। তখন সুজনের জীবনের সবচেয়ে সাফল্যময় দিন কাটছিল। তবুও কষ্ট দেখে দেখে বড় হওয়া সুজনের আশংকা হচ্ছিল সুখের পরের দূঃখকে নিয়ে।
.
অভিমান, ভালোবাসায় কাটছিল সুজন-দীপার সম্পর্ক। কোন এক দিন পরিবারের কাছেও সুজনকে পরিচয় করিয়ে দিল দীপা। কিন্তু সুজনের ভালোবাসার তরী একদিন সত্যি সত্যিই ডুবল।
.
দীপা সেদিন বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ল। বাথরুমে মাথা ঘুরিয়ে পরে গিয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে গেলে টেস্ট করে জানা যায় ক্রুশাল ব্লাড ডিজিস! ব্লাড নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
.
জীবনের বিরাট ধাক্কাটা খেল সুজন। আর দীপা তো থেকেও শেষ হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে দীপার চেহারা পরিবর্তন হতে লাগল। মনের চেহারাটা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ল যেন।
.
দেশের বড় বড় ডাক্তার দেখিয়ে কাজ হল না। ডাক্তার আয়ু দিল মাত্র ৪ মাস। সিঙ্গাপুর, লন্ডনে নিয়ে চিকিৎসা করালে আয়ু বাড়তেও পারে। কিন্তু বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। দীপার ফ্যামিলির টাকার অভাব ছিল না। কিন্তু অসুখটা এক্ষেত্রে সদয় ছিল না।
.
মৃত্যুটা হঠাতই হতে পারত। কিন্তু সুজনের কোলে মাথা রেখে চলে যেতে চেয়েছিল দীপা। বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে নিলে সুজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মারা যাওয়ার ভয় তাড়া করছিল দীপার মনে।
.
সেইদিন একটু বেশি আবদার করছিল দীপা। বলছিল সে চলে গেলে সুজন যেন ভাল কাউকে খুঁজে বিয়ে করে নেয়। সুজন অনবরত চোখের পানি ফেলছিল। মেয়েটার মুখের দিকে চেয়েও দেখলো না যে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল ওর। দীপা আস্তে আস্তে ঢলে পড়ল সুজনের কোলে।দেখা করতে আসার আগে ফার্মেসী থেকে এক শিশি বিষ এনে এমনভাবে খেয়ে নিয়েছিল যেন ধীরে ধীরে সুজনের কোলে মাথা রেখে মরতে পারে।
.
দীপা যে কখন অজানার দেশে পাড়ি জমাল টের পেল না সুজন।
.
সমাপন টীকাঃ সুজনের এক বছর ড্রপ যায় সেবার। সারাদিন পরে থাকত মেয়েটার কবরের পাশে। কোন এক ফার্মে জব করে এখন। বিয়েটা আর করা হয়নি। মনটা নিয়েই যে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে দীপা। আরামবাগ টু কমলাপুর টু কল্যাণপুর টু ফকিরাপুল টু আইডিয়াল কলেজে এখনো বিভ্রান্তের মতো হাটতে দেখা যায় তাকে। আজও দীপার কবরে সুজন নামের একটি ছেলেকে মাঝেমাঝেই পাওয়া যায়।
.
[ফুটনোট: নামদ্বয় কাল্পনিক। স্থান-কাল-পাত্র সব বাস্তব। বাস্তব ঘটনার সাথে কাল্পনিক কিছু পরিস্থিতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *