মার্চ মাসের শেষের দিক।
.
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন প্রতিকূল অবস্থায় ছিল। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই হাসান সাহেব পুরো পরিবার নিয়ে গ্রামে বেড়াতে গেলেন। তিনি ঢাকা শহরের সামান্য চাকুরিজীবী। শরীফ ও সোহরাব তার দুই আদরের সন্তান। দুই ভাইয়ের মধ্যে চরিত্রগত বেশ অমিল রয়েছে। সবসময়ে ছোট-খাট বিষয় নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি লেগেই থাকে। শরীফ বয়সে সোহরাবের চেয়ে বছর দুয়েকের বড়।
.
অনেকদিন পর দুই ভাই গ্রামে বেড়াতে এসেছে। প্রবল একটা উত্তেজনায় ঘিরে রয়েছে তাদের মাঝে। হাসান সাহেবের পুরো বংশধরেরাই গ্রামে স্থায়ী। কয়েক বছর ধরে দেশের প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য গ্রামে যাওয়া হয়নি। গ্রামের বাড়ি এসেও ইতোমধ্যে দুই সহোদরের মাঝে দু’একবার ঝগড়া হয়ে গেছে।
.
গ্রামে এসে আগের মতো হাসিখুশি নেই হাসান সাহেব। গত রাতে শুনলেন শহরে হামলা হয়েছে। চারিদিকে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। পাকিস্তানী মিলিটারিদের কব্জায় পুরো দেশ চলে গেছে। ব্যারিকেড দিয়েও জনগণ মিলিটারির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। ঢাকায় হয়তোবা শীঘ্রই আর তাদের যাওয়া হচ্ছে না অথবা আর কখনোই না যাওয়া হতে পারে।
.
আজ খুব ভোরে শরীফের ঘুম ভাঙল। যদিও সে কখনো এতো সকালে ওঠে না। হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের কোলঘেঁষে চলা নদীর ধারে চলে এল। গ্রামের সব কিছুর মধ্যেই কেমন অকৃত্রিম শান্তির পরশ পাওয়া যায়। তার কিশোর মনে এই ব্যাপারগুলো সহসাই ধরা পড়ছে। অপরূপ সকালের প্রকৃতি দেখতে দেখতেই সে নদীর পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে নিলো।
.
আচমকাই গাঁয়ের দিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ কানে ভেসে এল। আবার এই শব্দ শুনতে পেল। এবার যেন অবিরাম গুলি চলছেই। ভুল শুনছে না তো? নাহ্, ঠিকই শুনছে। শব্দটা বাড়ির দিক থেকেই আসছে। শরীফ অকস্মাৎ ভয়াবহ কিছু অনুভব করে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে গেল। আর্তনাদ আর চেহারায় ভীতির ছাপ নিয়ে লোকজন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। পেছনে বর্দি, বুট পরা কিছু লোক ধাওয়া করে গুলি করছে।
.
এদের কে সে চেনে। এরা মিলিটারি। শহরে এদের অনেক দেখেছে শরীফ। বাবা-মা, সোহরাবের কথা চিন্তা করে শরীফ চিন্তিত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ঝোপের আড়াল থেকে সোহরাবকে সে দেখতে পেল। এদিকেই আসছে। ভীতির ছাপ তার সমগ্র চেহারা জুড়ে। শরীফ ঝোপ থেকে বেড়িয়ে ভাইকে জাপটে ধরলো।
.
ভাইয়ের কাছ থেকে যা শুনল তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না শরীফ। কিভাবে সম্ভব? কেন এমন হল? শরীফ অনুভূতিশূণ্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর হুশ ফিরে পেল। সোহরাবকে রক্ষার দায়িত্ব এখন তারই। দুইজনে পরিবেশ শান্ত না হওয়া পর্যন্ত জঙ্গলেই লুকিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো।
.
দুই দিন ধরে পেটে কিছুই যায়নি। খিদে লাগেনি বলেই এ নিয়ে তারা ভাবেনি। হয়তোবা প্রেক্ষাপট তাদের খিদের অনুভূতিই নষ্ট করে দিয়েছে। এখন আর মিলিটারিদের গ্রামে দেখা যাচ্ছে না। তারা সিদ্ধান্ত নিলো আশেপাশে কোন বাড়িতে গিয়ে খেয়ে নিবে।
.
আপাতত নিজেদের বাড়ির কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। জঙ্গলের ধারেই একটি বাড়িতে প্রবেশ করল তারা। বাড়ির ভেতর থেকে পচন ধরা লাশের গন্ধ বেরুচ্ছে। এখানে সেখানে রক্তের দাগ। কাপড়-চোপড় এলোমেলো। হঠাৎ আলমারি নড়তে দেখা গেল। ভয়ার্ত চাহনি নিয়ে তাদের বয়সী একটা ছেলে বেরুল সেখান থেকে। তাদের মতোই বিপদগ্রস্ত, নাম আলামিন। এতোদিন ওখানেই লুকিয়ে ছিল। তিনজনেই ক্ষুধার্ত। আলামিন ঘর থেকে মুড়ি আর গুড় আনল। তিনজনে এগুলোয় খেয়ে নিলো।
.
পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে মনে করে শরীফ-সোহরাব আলামিনকে সঙ্গে করে তাদের বাড়ির দিকে রওনা দিল। বাবা-মায়ের শেষ দেখার জন্যই জীবন বাজি রেখে তাদের এই ঝুঁকি নেওয়া। বাড়ির উঠোনে এসে এক অচেনা নিস্তব্ধতা আবিষ্কার করল। বাবা-মা, চাচা-চাচী, চাচাতো ভাই-বোনদের লাশ দেখে আবেগ সামলাতে পারল না দুই ভাই। লাশগুলো সব অর্ধগলিত, পচে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল। সিদ্ধান্ত নিলো গণ কবর খুড়ে লাশগুলো মাটিচাপা দিবে। কোদাল নিয়ে নেমে পড়ল তিনজন। বিকেলের আগেই বড়সড় একটা গণকবর খোড়া হয়ে গেল।
.
বিকেলের দিকে হঠাৎ তিন-চারজন লোক এসে তাদের কাজে বাঁধা দিল। পোশাক-আশাকে তাদের বাঙ্গালী বলেই মনে হল।
.
– কি করতাছস তোরা? কুটুম্বগো কবর দিয়া দরদ দেখাইতাছস? যা তো মোতালেব-কদম, স্যারেগো ডাইকা নিয়া আয় গিয়া।
.
নির্দেশ পেয়ে দুইজন লোক পিছন দিক দিয়ে দৌড়ে গেল। সোহরাব বলল, ‘কাদের ডাকতে পাঠালেন আপনারা?’
.
– তোর বাপে গো। বলেই উদ্ভটভাবে হাসতে লাগলো সে…
.
শরীফ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আলামিনকে চোখের ইশারা করল। সাথে সাথে তাদের একজনকে ধাক্কা দিয়ে কবরে ফেলে দিল। আরেক সশস্ত্র লোককে দুইজনে মিলে চেপে ধরলো। এরপর শরীফ ছোট সোহরাবকে পালাতে নির্দেশ করল। সোহরাবের মন সায় দিচ্ছিল না। একমাত্র আপনকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাড়া করছিল তাঁর মাঝে। সে যেতে চাআচ্ছিল না। তবুও ভাইয়ের নির্দেশে চোখের জলকে অগ্রাহ্য করে দৌড়ে পালালো।
.
সোহরাব একটু আড়াল হবার পরই তাকেও গণকবরে ফেলে অস্ত্র ছিনিয়ে নিলো। রিভালবারটি তাদের দিকে তাক করে বলল, ‘তোরা আমাদের শত্রু। তোদের বাঁচিয়ে রাখলে আমার মৃত বাবা-মায়ের অপমান করা হবে।’
.
এই বলে দু’জনের দিকে পর পর দুটো গুলি করল। মৃত্যু নিশ্চিত করতে আরো কয়েকটা। অন্য দুজন কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্য নিয়ে এগিয়ে আসছিল, শরীফ চিন্তা করল বাকি গুলি দিয়ে যে কয়জন পারে মারবে সে। তিনবার ট্রিগারে চেপে দুইজনকে মারতে পারল সে। চতুর্থবার ট্রিগার চাপবার সময় পিছন থেকে কয়েকজন আর্মি তার মাথায় আঘাত করল। শরীফ, আলামিন দুইজনকে টেনে হিঁচড়ে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হল।